যে চুমু কথা কেড়ে নেয়, তা-ই আবার কথার জন্ম দেয়। অবিশ্বাস্য সব কথা। আর সেইসব কথা, সেইসব মুহূর্তকে ব্যারিকেড করে জিইয়েও রাখতে জানে চুম্বনই। তাই বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি দিয়েই বেঁচে থাকে অবিশ্বাস্য মুহূর্তরা। চুম্বন দিবসে ফিরে আসুক তেমনই অন্যরকম চুমুর গল্প।
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করার কথা যুগলেরা জানেন। কিন্তু ঠোঁটের ভাষা যে কেবল একমাত্রিক হয় না, সে কথা জানেন আরও অনেকেই। সন্তানের কপালে আগলে রাখার ছোঁয়া দিয়ে যায় মায়ের চুমু। দীর্ঘদিন পর দেখা হলে যে বন্ধু আবেগে ঠোঁট ছোঁয়ায় গালে, সেই স্পর্শও কি কেবল কামগন্ধের কথা বলে? না বোধহয়। চুম্বন আসলে কখনও প্যাশনে থরোথরো, কখনও আবার তা শান্ত মায়াবী ওমের মতো। আবার কখনও সেই চুমুতেই লেখা হয় বিদ্রোহের ইস্তেহার। একসময় প্রেমের উপর নীতিপুলিশি মানবেন না বলে ‘হোক চুম্বন’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ তুর্কি। চুম্বন সেখানে হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। আবার সংসদে শাসক দলের বিদ্রুপের হাসির উত্তরে যখন ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দেন রাহুল গান্ধী, তা নিয়ে রাজনৈতিক ভাষ্যের চর্চা চলে। অর্থাৎ, ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনও কথা না বলি’- এ কথা বোধহয় চুমুর ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। দেখা যাচ্ছে, সে নিজেই গড়ে নিয়েছে নিজস্ব এক বর্ণমালা, যার ব্যঞ্জনাও ছড়িয়ে পড়েছে প্রিজমের মতো। তাই কোনও একরকম চুম্বনের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে না চুম্বন দিবসও। আর সেই প্রেক্ষিতেই ফিরে দেখা যাক দুই অন্যরকম ঠোঁট মেলানোর গল্প।
আরও শুনুন:
ফুল নয় যেন তরুণীর ঠোঁট, কোথায় দেখা যায় এমন আশ্চর্য জিনিস?
সেটা ১৯৪৫ সালের ১৪ আগস্ট। পরপর দুই পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর কোমর ভেঙে গিয়েছে জাপানের। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে দেশ। এক কথায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবার শেষ। আর সেই আনন্দে টাইমস স্কোয়ারে উদযাপিত হচ্ছে Victory over Japan Day বা সংক্ষেপে V-J Day। সেই অনুষ্ঠানেই ক্যামেরা হাতে ছবির খোঁজে ঘুরছিলেন লাইফ পত্রিকার ফটোগ্রাফার আলফ্রেড আইনস্টাড। হঠাৎ তিনি দেখেন, এক তরুণ ছুটে আসছে। পরনে নাবিকের ইউনিফর্ম, অথচ উত্তেজনায় স্থান কাল পাত্র জ্ঞান যেন হারিয়ে গিয়েছে তার। পথে যাকেই পাচ্ছে, তাকেই চুমু খেয়ে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে সেই নাবিক। আর ঠিক সেই সময়েই ফোটোগ্রাফারের চোখ গিয়ে পড়ল দুধসাদা ইউনিফর্ম পরা এক নার্সের দিকে। কী ভেবে কে জানে, দুজনকে এক ফ্রেমে দেখার জন্যই যেন নিশানা করলেন তিনি। হয়তো তাঁর সেই নীরব চাওয়ার জোরেই, আচমকাই নার্সের দিকে ছুটে এল ওই নাবিক, আর তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট বসাল ঠোঁটে। আর সেই মুহূর্তটিই চিরস্থায়ী হয়ে রইল আইনস্টাডের ক্যামেরায়।
আরও শুনুন:
সিনেমার পর্দায় ‘প্রথম চুম্বন’, ট্যাবু ভেঙে পথ দেখিয়েছিলেন দেবিকা রানি
এ গল্পে কেউ কাউকে চিনতেন না। ছিল না কোনও আবেগ বা অনুভুতিও। চুম্বন এখানে হয়ে উঠেছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের ধারক। সম্প্রতি তেমনই এক লড়াইয়ের মুহূর্তে দেখা গিয়েছিল অন্যরকম এক চুমুর ছবি। উত্তরকাশীর সেই অভিশপ্ত সুড়ঙ্গে যখন আটকে পড়েছিলেন ৪১ জন শ্রমিক, টানা ১৬ দিন ধরে প্রতিক্ষায় ছিলেন এক বাবা। আরও সকলের বাবা মা স্ত্রী সন্তানের মতোই, কড় গুনে গুনে পার করছিলেন অপেক্ষার প্রহর। শেষ পর্যন্ত ছেলে মনজিত যখন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসেন, আর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ছেলের কপালে এঁকে দিয়েছিলেন চুমু। দেশের এক সাধারণ, খেটে-খাওয়া, পিছিয়ে থাকা মানুষ সেই মুহূর্তেই এক ইতিহাসেরই অংশ হয়ে উঠেছিলেন। সে ইতিহাস পিতৃত্বের চিরন্তন প্রতিরোধের। সে ইতিহাস মানুষের প্রতিরোধেরও বটে। যে প্রতিরোধের গল্পে সবরকম প্রতিকূলতার মুখে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ আর মানুষের জুড়ে থাকা। এই দুই গল্পেই, সেই জুড়ে থাকার ভাষ্য হয়ে উঠেছিল চুম্বন।