আমের জন্য বরাদ্দ নাকি আস্ত একটা দিন! নামে যাই হোক, আম জিনিসের মধ্যে যে তাকে মোটেই ফেলা যায় না, সে তো এখান থেকেই স্পষ্ট। তাহলে আসুন, আমকাহনেই নাহয় কান পাতা যাক।
‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’… জাতীয় সংগীতে এমন কথা বলা বাঙালিরই সাজে। ভারী ভারী শব্দের বদলে যা প্রাণের ভারি কাছাকাছি, তারই কথা। আর আম যে বাঙালির প্রাণের জিনিস, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে! বাংলার আম আর বাঙালির আমপ্রীতি, নিঃসন্দেহে একে অপরকে টেক্কা দিতে পারে। যত দিন কেটেছে এই আম কেবল বাঙালির রসনাকেই তৃপ্ত করেনি, বরং ফলের রাজা হয়ে সে জাঁকিয়ে বসেছে বাঙালির শাস্ত্রাচার, লোকাচার, শিল্পেও। নারায়ণ পুজো হোক কিংবা দুর্গাপুজো, কিংবা বাংলার ঘরোয়া ব্রত, আমের পল্লব সেখানে সগৌরবে হাজির। আবার পুজোয় যেমন, তেমনই পেটপুজোয় আমের সোচ্চার হাজিরা।
বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, আম খাওয়া ও খাওয়ানো নিয়ে তাঁদের শৌখিনতার গল্প অনেক। শোনা যায়, বাজার থেকে নিজের হাতে বাছাই করে ভালো জাতের আম এনে পাতার বিছানায় সেগুলি সযত্নে রেখে, দিন দুয়েক ওলটপালট করে সেই আম পাকাতেন বিদ্যাসাগর মশাই। শুধু তাই নয়, বঁটি দিয়ে কাটতেনও নিজের হাতেই। রবীন্দ্রনাথও ফলের মধ্যে কেবল আমটাই ভালোবাসতেন, বলেছেন রাণী চন্দ। আম খাওয়ার বিশেষ কায়দাও ছিল তাঁর, ছুরি দিয়েই খোসা আলাদা করে বের করে নিতেন শাঁস, আর তারপর ধরতেন কাঁটাচামচ। এদিকে কোন এক রাজার অতিথি হয়ে একবার পড়েছিলেন মুশকিলে। কবির খাওয়ার সুবিধা হবে মনে করে ভালো ভালো আমগুলি হাতে চেপে নরম করে দিতেন খোদ রাজামশাই। কে আবার বাটিভরা ঘিয়ের সঙ্গে আম সাজিয়ে দিয়েছিলেন, সে গল্পও করেছেন রাণীর কাছে। ‘আকাশপ্রদীপ’ বইতেও ‘কাঁচা আম’ কবিতায় কাদম্বরী দেবীর ঠাকুরবাড়িতে আসার প্রথম দিনগুলি মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেখানে নতুন বউঠানের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ মিলত কাঁচা আমের হাত ধরেই। কেননা শুল্পো শাক আর লঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে কাঁচা আম খাওয়ার শখ ছিল কিশোরী বধূর। তেমনই আবার ঠাকুরবাড়ির ছাদে বাড়ির মেয়েদের বানানো আমসত্ত্ব আর কেয়া-খয়ের তুষ্ট করত স্কুল-পালানো ছেলের পণ্ডিতমশাইকেও।
আরও শুনুন:
খাবার নয়, এককালে ঘর সাজানোর কাজেই লাগত আলু
তবে আমের উপর কেবল আম বাঙালির একাধিপত্য নেই। তিন হাজার বছর আগের ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’-এ প্রথম আমের উল্লেখ পাওয়া যায়। খনার বচনে যেখানে কোন মাসে কী খাবেন বলা হয়েছে, সেখানেও জৈষ্ঠ্যে অমৃতফলের উল্লেখ আছে। আবার চৈতন্যচরিতামৃতে আম দিয়ে তৈরি নানা পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। মনে করা হয়, চৈতন্যদেবের সময়েই বাঙালি হেঁশেলে পাকা রসালো আমের চল বেড়েছে। কারণ ভক্তি আন্দোলনের সময় যখন নিরামিষ রান্নার অনেক বেশি প্রসার ঘটল, সেই সময় ঝাল খাবারেও মিঠে আমের ব্যবহার শুরু হয়।
তবে আম নিয়ে আমোদের শুরু কিন্তু মুঘল যুগেই। আজকের দিনে খাদ্যাভ্যাসে ‘মুঘল’ তকমা লাগিয়ে নেতারা যতই দোষারোপ করুণ না কেন, মুঘল বাদশারাই বিপুল পরিমাণে আমের ফলন শুরু করেছিলেন। দ্বারভাঙার কাছে লাখবাগে এক লক্ষ আমগাছের বাগান তৈরি করেছিলেন বাবর। আকবরের সময় মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন আমবাগানে দুষ্প্রাপ্য ২০০ রকমের আমের প্রজাতির ফলন হত। পরবর্তী কালে নবাব সিরাজদৌল্লা এবং মুর্শিদকুলি খাঁ দুজনেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির চারা আনিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল সব আমবাগান। লাল কেল্লায় আমবাগান বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দিল্লির শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর-ও। গল্প আছে, একদিন বাদশাহের সঙ্গে সে বাগানে হাঁটছিলেন মির্জা গালিব। এদিকে মুখে কথা নেই। গাছে গাছে থরে থরে আম ঝুলছে, বিচিত্র তাদের বর্ণ গন্ধ, সেদিক থেকে আর চোখ সরছে না মির্জার। তিনি তো মনেই করতেন, আমের কেবল দুটি গুণ থাকা জরুরি- তা হবে মিষ্টি, আর পরিমাণে প্রচুর। সেই মির্জা এত আম দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে তো যাবেনই। অবশেষে আওড়ালেন এক শায়ের, যার মানে দাঁড়ায়- প্রতি বীজে লেখা থাকে, কোনটিতে কার ছেলের অধিকার। আর তারপরেই জুড়ে দিলেন, এখানকার কোনও আমে কি আমার কিংবা আমার বাপ-দাদার নাম লেখা রয়েছে? এ কথা শুনে কী হয়, তা অবশ্য বলাই বাহুল্য। মির্জার বাড়িতে সেদিনই পৌঁছেছিল ঝুড়িভরা সেরা আম।
আরও শুনুন:
Biryani: বাঙালির বিরিয়ানিতে আলুর ঠাঁই হল কীভাবে?
তবে বাবর-আকবর-জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে কেবল রাজা-বাদশাদের বাগানেই আমের ফলন হত, আমজনতার সেই আম চেখে দেখার সুযোগ হত না বললেই চলে। শাহজাহানের সময় থেকে আমজনতাও আমের স্বাদ উপভোগ করার অধিকার পেলেন। শাহজাহানের ঘোষণায় সাধারণের বাগানেও শুরু হল আমের ফলন। আজকেও, আমজনতার নাগাল আর কোথাও না পৌঁছক, আমের দখলদারি সে ছাড়তে নারাজ।