আমাদের জীবনেও কোনও ম্যাজিক স্পেল থাকে না। থাকে না ম্যাজিক ওয়ান্ড। তবুও জীবন যে কীভাবে অন্যরকম হয়ে ওঠে, সেই গোপন হলদে পাখির পালক চিনিয়েছিল হ্যারিও। হ্যারি পটার।
হ্যারি,
মার খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের জীবনেও কোনও একটা আলো এসে পড়ে হঠাৎ করে। হঠাৎ কোথাও কোনও একটা দরজা খুলে যায়। সে দরজাটার আড়ালে মার-খাওয়া মানুষের জন্যও একটুখানি নিজের জায়গা জুটে যায়। আর সেই দরজাটাকেই আমরা নাম দিয়েছি ম্যাজিক।
এই গোপন কথাটা ২৭ বছর আগে চুপিচুপি জানিয়ে দিয়েছিলে তুমি। তার আগে তুমিও সে কথা জানতে থোড়াই! জ্ঞান হয়ে থেকে মা-বাবাকেই তো দেখতে পাওনি। কোনও দিন মায়ের হাতে বেক করা কেকের গন্ধে নাক ডুবিয়ে দেওয়া হয়নি তোমার। বাবার হাত ধরে মাঠে ছোটাছুটি করা হয়নি। আদর শব্দটা না শিখেই তোমার জীবন থেকে নিঃশব্দে ঝরে গিয়েছে এগারোটা বছর। সে জীবনে মার খাওয়া আছে, উঠতে বসতে বকুনি আছে, ঘরের কাজ সারার কঠিন দায় আছে, আর সবটা জুড়ে আছে স্যাঁতসেঁতে এক অন্ধকার। এক্কেবারে একলা থাকার হু হু আঁধার। সেই আঁধারে মুখ গুঁজে তোমার রোজ পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত বইকি! ওইটুকু বয়স আর কত সইবে! কিন্তু চারদিকেই তো শক্তপোক্ত দেওয়াল, পালাবে কোথায়! অথচ, একদিন তোমার সামনেই সেই দরজাটা খুলে গেল হঠাৎ করে। এক প্রবল ঝড়ের রাত ছিল সেটা। তোমার সেই গোলগাল আদুরে মাসতুতো ভাই, যার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ‘হবি’ ছিল তোমাকে উত্যক্ত করা, সে তার মধ্যেও পাশে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছিল। কেবল তোমার চোখে ঘুম ছিল না। ভাইয়ের রেডিয়াম ঘড়ির কাঁটায় নজর রেখে তুমি মিনিট গুনছিলে, ১২টা বাজতে ঠিক কতক্ষণ বাকি। তুমি জানতে, প্রতিবারের মতো এবারও তোমার জন্মদিনটা কেটে যাবে ঠিক একইরকম একলা হয়ে। রোজকার ফাইফরমাশ খেটে। রোজকার পুরনো ঢোলা পোশাক আর ভাঙা চশমায়। কারণ তুমি জানতে, আসলে ম্যাজিক বলে সত্যি কিছু নেই।
তুমি যে কথা জানতে না, তা হল, ম্যাজিকেরা চুপিচুপি গুটিশুটি মেরে থেকে যায়। তাদের যখনতখন আসতে নেই। তুমি জানতে না, আসলে ম্যাজিক হল মানুষের মনের গুণের মতো, কষ্ট না পেলে ফুটে ওঠে না। কিংবা ওই কষ্টই হয়তো সেই সোনার কাঠি, যাকে সম্বল করেই মানুষ মারের সাগর পাড়ি দিতে পারে। তবে বাকি জীবন তোমায় সে কথাই শিখিয়েছে একটু একটু করে। তুমি তো সেইসব রূপকথা সিনেমার নায়ক নও, যেখানে জাদুকাঠি ছোঁয়ালেই দিন বদলে যায়। জাদুকাঠি নাড়িয়েচাড়িয়ে তোমার পড়া মুখস্থ হয়ে যায় না। সেই অঙ্কে তেরো পাওয়া বুরুনের মতো নিধিরাম ভূত এসে তোমার হোমওয়ার্ক কষে দিয়েও যায় না। এমনকি বিপদের মুখেও জাদুকাঠি তোমার হাতিয়ার মাত্র, তোমার রক্ষক নয়। লড়াইটা আসলে লড়তে হয় তোমাকেই।
আর এইখানেই, আমাদের সবার জীবন কোনও না কোনওভাবে মিলে যেতে থাকে। বরং তোমার বন্ধু নেভিলের মতোই বড়দের অতি প্রত্যাশা, অন্যদের সঙ্গে তুলনার চাপে আমাদের অনেকের আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে যায়। রনের মতোই কেউ কেউ মা-বাবার পকেটের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে টেনেটুনে ফুটোফাটা ঢাকতে চায়। হারমাইনির মতো জাতপাতের খোঁটাও শুনতে হয় কতজনকে। তবে তোমারই মতো, আমাদের পাশেও এসে হাত বাড়িয়ে দেয় কোনও কোনও মানুষ। তারাও জাদুশক্তিতে বলীয়ান নয় কেউ। কিন্তু তারা বুঝিয়ে দেয়, শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যতখানি সাহস লাগে, যে কোনও সময়ে বন্ধুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার চেয়ে কম সাহস লাগে না। আর তোমায় ছুঁয়েই আমরা বুঝতে পারি, সেই মনের জোরের নামই আসলে ম্যাজিক।