যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছেন বহু বাসিন্দা। আশ্রয় নিয়েছেন পড়শি দেশগুলিতে। আশপাশের অনেকে ঘর ছাড়লেও ছাড়েননি ৭৭ বছরের এই বৃদ্ধা। কী করেই বা ছাড়তেন! তাঁর ভরসায় যে বেঁচে রয়েছে শতাধিক অবোলা প্রাণী। যাদের দায়িত্ব গত দু-যুগ ধরে পালন করে এসেছেন তিনি। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন তিনি। লড়ে চলেছেন অন্য যুদ্ধ। আসুন, শুনি বৃদ্ধার সেই লড়াইয়ের কথাই।
রুশ হানায় ক্ষতবিক্ষত ইউক্রেন। ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অসংখ্য বাসিন্দা। তবু তার মধ্যেই মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন অনেকে। একদিন সব কিছু শান্ত হয়ে যাবে, এই আশায় বুক পেতে রেখেছেন। কান পাতলেই গুলি, গোলার শব্দ, বাতাসে পোড়া বারুদের ঘ্রাণ। প্রাণ বাঁচাতে যে যেখানে পারছেন মাথা লোকাচ্ছেন। মৃত্যুভয় সত্ত্বেও এত সহজে নিজের বাড়িঘর ছাড়তে পারেননি ৭৭ বছরের এই বৃদ্ধাও। ছাড়তে পারেননি এতগুলো অবোলা প্রাণীকেও।
আরও শুনুন: যুদ্ধে পা হারিয়েও হারাননি মনোবল, বিয়ের অনুষ্ঠানে নেচে নজর কাড়লেন ইউক্রেনের নার্স
প্রায় দু-যুগ আগে তিন সহকর্মীর সঙ্গে মিলে পশুপাখিদের জন্য একটি আশ্রয় তৈরি করেছিলেন আশয়া সেরপিনস্কা নামে ওই মহিলা। প্রায় দু দশক কেটেছে আশ্রয়ের সেই পশুদের নিয়েই। যুদ্ধের আঁচ থেকে বাঁচতে এক লহমায় সেই সব অবোলা প্রাণীগুলোকে বিপদে ফেলে পালাতে মন চায়নি কিয়েভের এই বৃদ্ধার।
বরং পালানোর চিন্তা দূরে ফেলে দিয়ে যুদ্ধক্লান্ত ইউক্রেনের অসহায় কুকুর-বিড়ালদের অভিভাবক হয়ে উঠেছেন আশয়া। সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে অন্তত ৭০০ কুকুর ও শতাধিক বিড়ালকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। এমনকি আশ্রয় দিয়েছেন একটি সিংহকেও।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল রাশিয়া। এক লহমায় দেশ জুড়ে নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। চারদিকে রুশ বাহিনীর টহল, মাথার উপর বোমারু বিমান, গুলি-বোমার শব্দ, একটা সময় মনে হয়েছিল, পালিয়ে নিজের প্রাণটা বাঁচাবেন কোনও মতে। তার পরেই মনে পড়ে যায় প্রাণীগুলোর কথা। দৌড়ে যান ওই আশ্রয়ে। মনে পড়ে যায়, আশয়ার ভরসাতেই অতগুলো প্রাণী রয়েছে। ওদের সকলের দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। আর পালানোর কথা ভাবতে পারেননি দ্বিতীয় বার।
এরই মধ্যে রুশ বোমার আঘাতে প্রাণ গিয়েছে তাঁর আশ্রয়ের বেশ কিছু পশুর। বেশ কয়েকটি কুকুরকে গুলি করে মারে রুশ সেনা। সেই দৃশ্যগুলো ভেবে শিউরে ওঠেন আশয়া।
তবু হার মানেননি তিনি। যুদ্ধের ক্ষত সামলে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে পশুদের খাবারদাবারের জন্য বরাদ্দ ফ্রিজটি বন্ধ হয়ে যায়। কোনও ক্রমে পোর্টেবেল একটি জেনারেটার জোগার করে ওদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। আশয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন বেশ কয়েক জন স্বেচ্ছাসেবী। পাশে ছিলেন স্বামীও।
বরাবরই পশুপাখি ভালবাসতেন আশয়া। অঙ্কের অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পরে ওই পশুরাই হয়ে উঠেছিল তাঁর দুনিয়া। ওই আশ্রয় নিয়েই পড়ে থাকতেন দিনরাত। তাদের ছেড়ে, নিজের দেশ ছেড়ে পালানোর কথা ভাবতেও পারেন না আর। আর সে নিয়ে বিন্দুমাত্র আফশোশও নেই তাঁর। মরতে হলে ওদের সঙ্গেই মরবেন, এমনটাই ইচ্ছা বৃদ্ধার। রুশ বাহিনীর নৃশংসতার সামনে যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন, তাঁর প্রশংসা করেছে গোটা দুনিয়া।