দ্রোহ থেকে প্রেম। সোশ্যাল মিডিয়া না-বললে আমাদের অস্তিত্ব নেই। বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস-এর মধ্যে তা যেন অমোঘ! কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার ভ্যালিডেশন আদতে কি এতটাই জরুরি! নাকি তা নিছক আসক্তি! নতুন বছরে এ-প্রশ্ন করা জরুরি।
লিখলেন রোদ্দুর মিত্র। পড়ে শোনালেন চৈতালী বক্সী। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
উঠে যাওয়া সিঁড়িতে দেখা হয় দু’জনের। নিঃশব্দে। অপলক চোখে চাইতে পারে না কেউ। টিফিনবাক্স হাতে মেয়েটি খাবার নিতে আসে। ফিরে যায় যে আলো-আঁধারি পথে, ছেলেটি সে-পথ ধরেই নামে। হাত কখনও শূন্য। কখনও সিগারেট। দু’জনেই ভালোবেসে ঠকেছে। বিবাহে কত ছল ছিল! তাই কাছে আসতে ভয়। সংসার। সময়। সংগোপন। কী তীব্র সেই চক্ষুলজ্জা! ততদিনে আলো-আঁধারি পথে শব্দ জন্মেছে। থইথই করে। আমরা ভাবি, এই হয়তো বাঁধ ভাঙল। তা হয় না। কেবল চোখের জল ছুঁয়ে যায় একে অন্যকে। স্ক্রিনের বাঁ-দিকে মেয়েটির বিষাদ বিষাদ মুখ। গলার কাছে তিতির পাখির ছটফটানি। দূরে ছেলেটির হেঁটে যাওয়া। কান্নার ভারে মুখ নিচু। এরপরই ছবিটির পরিচালক, ওং কার-ওয়াই,বলবেন, ‘অল মেমোরিজ আর ট্রেসেস অফ টিয়ার্স’।
বলছিলাম, ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ ছবির কথা।এই কান্না, এই আশ্চর্য প্রেম, এই হৃদয়ের অন্তর্গত অস্থিরতা আসলে ভীষণ ব্যক্তিগত স্মৃতি। আমরা মুগ্ধ হয়ে তা-ই দেখেছি। ভেবেছিও। উত্তর-আধুনিক সময়ে মুগ্ধতা গেছে ঘুচে। অথবা প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ হতে হতে, মুগ্ধতার বোধ একেবারে ভোঁতা। হে পাঠক, হে শ্রোতা, প্রেম তো এক ধরনের মুগ্ধতা। তবু প্রেমে পড়লে কেন বেহালা বেজে ওঠে না? তলপেটে ওড়ে প্রজাপতি? শুধু ফেসবুকে আপলোড হয় ছবি। ইনস্টাগ্রামের নান্দনিক রিলে ছুঁয়ে থাকেন প্রেমিক অথবা প্রেমিকার হাত। ব্যাকগ্রাউন্ডে চারপিস কাঠগোলাপ। সঙ্গে রবিঠাকুর। ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে…
নিভৃতি-টা কোথায় মশাই? প্রোফাইলে রিলেশানশিপ স্টেটাস বদলে গেছে। সটান এনগেজড উইথ অমুক। এইবারই ম্যাজিক। কমেন্ট বক্সে হামলে পড়ছে জনতা। কঙ্গো থেকে কিউট কাপল, রঙ্গ হেবি! এইখানেই প্রশ্নটা পেড়ে ফেলি। ‘কথোপকথন’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন, শুভংকর ও নন্দিনী ভালোবাসায় জ্বলে। সে জ্বলন কি তবে সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্ট চায় আজকাল? ভার্চুয়ালি ভ্যালিডেশন না পেলে সে প্রেম তবে মরে যাবে? সর্বনাশ! প্রেমের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুহূর্ত— তর্ক, আদর, যৌনতা, অভিমান, রাগের ছলাকলা যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছি টাইমলাইনে। সকলে দেখুন, প্রেম কত পরিপাটি। আমাদের প্রেমের সংগ্রহশালায় আপনাকে স্বাগত!
শুধু প্রেম নয়, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম সকল অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার নির্জীব সংগ্রহশালা। ইন্টারনেট ছাড়া কোনও অস্তিত্বই নেই। এতই ঠুনকো! কিন্তু আমাদের ভ্যালিডেশন লাগবে। লোক দেখাতে হবে। প্রচার করতে হবে, দেখো ভাই আমি কত প্রেমে আছি। অথবা নেই। তা কেউ যদি লোকদেখায়, প্রেমের গোপন খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়, আপত্তি কী? নেই তো। শুধু বলছি, সে ভালোবাসা আদতে টালোবাসা। টিকবে না বেশিদিন। যদি টিকেও যায়, সে ভালোবাসায় প্রেমযুগলের যা অধিকার, তার চাইতে যেন ঢের বেশি অধিকার পাবলিকের। ভ্যালিডেশনের। যদি ভ্যালিডিটির মেয়াদ ফুরিয়ে যায়? তবে কি প্রেমও ফুরিয়ে যাবে? বিচ্ছেদেও দিব্যি ভ্যালিডেশন পাওয়া যায়। কেজি কেজি।
আঘাত করতে চাইছি ভ্যালিডেশানই। সোশ্যাল মিডিয়া যেহেতু বলছে, ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’, তাই আপনাকেও বলতে হবে। নেটপাড়ায় ঠাঁই মিলবে তবেই। নইলে বিদায়। অথচ ফেসবুকের একখানা স্টেটাসে আপনার রাজনৈতিক বোধের স্টেটাসও বৃদ্ধি পাবে, লাইক পাবে, শেয়ার হবে হু-হু, সে ধারণা আদ্যোপান্ত ভুল। এহেন পলিটিক্যাল কারেক্টনেস লোকদেখানো। প্রেমের মতো, প্রতিবাদও তাই। যে দলিত ছেলেটা মন্দিরে জল পায়নি, দু’-কলম লিখলে মনের আগুন নেভে। রাষ্ট্রও আসলে সেটাই চায়। মনের আগুন একবার যদি ফোনের স্ক্রিনে মিটে যায়, তবেই কেল্লাফতে! তবেই ভোটবাক্সে কোনও ফাউল হয় না। বরং দেদার ফুল ফোটে। হেব্বি না? জ্ঞান বিতরণের সুরেই বলি, নতুন বছরে প্রতিবাদের ক্ষেত্র হিসেবে যদি বেছে নিতে পারেন নিজের পারিপার্শ্বিক, পৃথিবী কিঞ্চিৎ সুন্দর হয়। যেখানে ভ্যালিডেশানের কোনও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু আপনার মুক্তদৃষ্টির। স্পষ্ট রাজনৈতিক বোধ। কেউ একজন বলে দেওয়ার পরে টের পেলেন, দৃশ্য বা ঘটনা কত ঘৃণ্য কিংবা সুন্দর, এমনটা হলে আত্মার সঙ্গে ছলনা হয়ে যায় না মশাই?
তাই ফিরে আসি ইন দ্য মুড ফর লাভ-এ। প্রেমে। প্রতিবাদে। আমরা দেখছি, সময় এগিয়ে গেছে সিনেমায়। দু’জনের কেউ হংকং শহরে থাকে না আর। ছেলেটি যখন ফিরে আসে, জানলা দিয়ে দেখে পাশের বাড়িতে মেয়েটির মুখ। এবং একটি ছোট্ট মেয়ে। এ-দৃশ্য কাট করে ওং কার-ওয়াই আমাদের হাজির করেন অতি পুরনো একটি বৌদ্ধ মন্দিরে। ছেলেটি মুগ্ধ হয় মন্দিরের কারুকীর্তিতে। শিল্পে। আদিমতায়। মন্দিরের শরীরে, একটি ছিদ্রে, মুখ লাগিয়ে ছেলেটি কথা বলে। তারপর বুজিয়ে দেয় ঘাস আর কাদায়। সে শুনেছিল, প্রাচীনকালে কোনও মানুষ, জীবনের সবচেয়ে গোপনীয় যে কথা, এভাবেই রেখে দিত গাছের কোটরে। ধরে নিলাম, সে-কথা কেবলমাত্র ভালোবাসার। কেমন ফসিল হয়ে গেল। ভ্যালিডেশন ছাড়াই। সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনে নয়। এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে।