ঘুম তো মানুষের বার্থ রাইট। জন্মেছে বলেই তাকে জাগতে হবে, আর ঘুমোতেও হবে। তাই ঘুমকে যত দূরে ঠেলে রাখা যায়, সে তত হয়ে ওঠে আস্ত প্রতিবাদ। দেখা যাবে, যেখানে জেগে থাকা জরুরি সেখানেই তার অমোঘ আনাগোনা। ক্লাসরুম কি আর সাধে ঘুম-ঘুম! রাজনীতি আর অর্থনীতি তাই পৃথিবীকে নিয়ে চিল চিৎকার করুক। সকল এল-গেলর ভিতর দেখবেন কেউ কেউ দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। যাকে লড়াই করে পেটের ভাত জোটাতে হয়, ভাতঘুম তার সাধের অমরাবতী।
ভাতঘুমের জন্য বাঙালির বিস্তর বদনাম! পেটে ভাত পড়লেই নাকি দু-চোখ জুড়িয়ে আসে। আর তখন কাজ-টাজ সব চুলোয়! খানিকক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে না পারলে যেন শান্তি নেই। কাজের অরণ্যে প্রাচীন প্রবাদ, যে ঘুমিয়ে থাকে, তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে থাকে। অতএব যেই না কোনও কিছুতে বাঙালি একটা ধাক্কা খায়, অমনি সব দোষ গিয়ে পড়ে বেচারা ঘুমের উপর। অথচ ওই ভাতঘুম টাইপ ব্যাপার, যাকে কায়দা করে ‘ন্যাপ’ বলা হয়, তার জন্য যে আস্ত একটা দিন ধার্য হয়েছে, এ কথা ভেবে বাঙালির স্বস্তিই পাওয়াই উচিত।
-: আরও শুনুন :-
তবে, ভাতঘুম একা বাঙালির সম্পত্তি নয়। গ্রিস থেকে স্পেন, যেদিকে তাকাবেন সর্বত্রই ঘুমের রমরমা। রোমে তো নাকি আবার ডাক্তারবাবুরা প্রেসক্রিপশনে ঘুমের কথা লিখে দিতেন। অর্থার এই ছোট্ট স্পেলের চমৎকার ঘুম হচ্ছে শরীরের জন্য মহৌষধ। এ কথা ঠিক বাঙালি যেদিন থেকে ভাতঘুম উদযাপন করে, সেদিন এই ‘ন্যাপ ডে’ ব্যাপারটির অস্তিত্বই ছিল না। তবে তাতে কী! ঘুমের যে ঐশ্বরিক তৃপ্তি, তা সে কনওদিনই হাতছাড়া করতে চায়নি। তবে কিনা, কাজের পৃথিবী ঘুমকে বড্ড দুয়ো দেয়। ঘুমোলেই সব কাজ মাটি। চব্বিশটি ঘণ্টাই তাই জেগে থাকার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলতে পারলে অনেকে খুশি হন। নেহাত শরীররক্ষার একটা দায় থাকে। তাই ছিটেফোঁটা ঘুম হলেই চলে! সে সব বেশ ফলাও করে বলাও হয়। জীবনে উন্নতি আর ঘুম যে পরস্পর সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া এরকম একটা সূত্র কবে যেন মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেসবের সমর্থনে আবার টেনে আনা হয় মহামানবদের। তাঁরা নাকি মোটে দু-তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোন না। পালটা যুক্তি হল, তাঁদের মাথার উপর গুরুদায়িত্ব। তাই ঘুমের সঙ্গে তাঁদের বিচ্ছেদ নাহয় সাব্যস্ত হল। তাই বলে দু-দণ্ড ঘুমিয়ে পড়ার অবসর যিনি পান, আর তা সগৌরবে কাজে লাগান, তাঁকে দোষ দেওয়া নেহাতই বেরসিক ব্যাপার।
-: আরও শুনুন :-
দেখা যাচ্ছে, এই ন্যাশনাল নাপিং ডে পালন ব্যাপারটার বয়স মোটে বছর চব্বিশ-পঁচিশ। বস্টনের এক অধ্যাপক আর তাঁর স্ত্রী দিনটির সূচনা করেন। দিন বদলের হিসাব তিসাব রেখে ক্লান্তির একটা চূড়ান্ত সীমা নির্ণয় করেন তাঁরা। সেখান থেকেই ১১ মার্চকে নির্বাচিত করেন ঘুমের দিন হিসাবে। না সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানোর কথ আওবিশ্যি বলা হচ্ছে না। তবে ঘুম যে নেহাতই বাজে ব্যাপারটা নয়, এই কথাটাই মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আজকাল চিকিৎসকরাও বলছেন, ঘুমকে দুয়ো দিলে শরীরেরই বারোটা বাজে। এমনিতেই স্ট্রেস আর ডিপ্রেশনের জোড়া ফলা। আর সেই আগুনে ঘি দেওয়ার জন্য আছে নির্ঘুম রাত। ঘুমপাড়ানি গানের দিন ফুরিয়ে এলে আসে তাই ওষুধের পাতা। কাজ-জীবনের ভারসাম্য ঘেঁটে যাওয়া জীবনে মোটামুটি তা দস্তুর হয়ে গিয়েছে। তাই ঘুমকে একটু বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তার জন্য একটা দিন বরাদ্দ করা নেহাত খারাপ কিছু নয়।
তবু, এ দিনেরও কি আর তেমন গুরুত্ব আছে! সেভাবে স্বীকৃতিই তো পায়নি। আসলে জেগে থাকা কিংবা জেগে ওঠার মধ্যে যে বীরত্বগাথা রাখা, ঘুমের জন্য তো আর সেসব নেই। যে কোনও জাগরণকেই তাই ঘুমের উলটোদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘুম তাই যেন স্যাঁতসেতে অন্ধকার একটা ঘর। আর জেগে থাকা আলোঝলমলে সাতমহলা। জাগরণ ইতিবাচক, ঘুম নেতিবাচক। জাগরণ নায়ক, ঘুম খানিক পার্শ্বচরিত্র, কখনও খলনায়ক। কুম্ভকর্ণ তাই কাউকে খোঁচা দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র। এমনকী রোমান্সের সঙ্গেও তার আড়ি পাতিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে পড়তে পারে, তাই বলে কি ঘুম-ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারার রাতে নায়ক-নায়িকার ঘুমিয়ে পড়লে চলে! জীবনের গদ্যে কিংবা কাব্যে তাই ঘুমকে কোণঠাসা করে দিয়েই তাই দিব্যি চলছে জাগরণের এক্কাগাড়ি।
তবে, ঘুম তো মানুষের বার্থ রাইট। জন্মেছে বলেই তাকে জাগতে হবে, আর ঘুমোতেও হবে। তাই ঘুমকে যত দূরে ঠেলে রাখা যায়, সে তত হয়ে ওঠে আস্ত প্রতিবাদ। দেখা যাবে, যেখানে জেগে থাকা জরুরি সেখানেই তার অমোঘ আনাগোনা। ক্লাসরুম কি আর সাধে ঘুম-ঘুম! রাজনীতি আর অর্থনীতি তাই পৃথিবীকে নিয়ে চিল চিৎকার করুক। সকল এল-গেলর ভিতর দেখবেন কেউ কেউ দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। যাকে লড়াই করে পেটের ভাত জোটাতে হয়, ভাতঘুম তার সাধের অমরাবতী। ছাড়তে বললেই ছাড়া যায় নাকি! বিপন্ন দুনিয়ার বিষণ্ণতা কাটিয়ে ঘুমন্তের মুখে ভাসে নিষ্পাপ আলো। সেই মুহূর্তে ঈশ্বর স্বয়ং মৃদু স্বরে গেয়ে ওঠেন ঘুমপাড়ানি গান। জেগে থাকার পৃথিবী তার হদিশই পায় না কখনও।