শীতের বেলায় ভোট হলে সংখ্যাগরিষ্ঠে সমর্থন রোদ্দুরের প্রতিই। আর শীতের রোদ্দুর কাউকে শূন্য হাতে ফেরায় না। তা যেন আসলে শ্রেণিহীন সেই স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন দেখায়, যা সকলের প্রতি সমবণ্টন করা যায়, কিন্তু যা কোনও দিনই মাটির বুকে সত্যি সত্যি নেমে আসে না।
‘শীতকাতুরে’ সিরিজে সেই শীতের রোদের সমর্থনে কলম ধরলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
পড়ে শোনালেন চৈতালী বক্সী, অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
শীতের থাবা যত এগিয়ে আসে, মানুষ তত পিছু হটতে থাকে।
আক্রান্ত হলে যেমনটা তার গড়পড়তা অভ্যাস। যে কোনও আক্রমণের মুখোমুখি হলেই সে খুঁজবে নিরাপত্তার ওম। মেলে কি মেলে না, তবু খোঁজ জারি না রাখলে যে জাঁকিয়ে বসবে হিম। শীতের দিনে তার সেই খোঁজকে একটু সহজ করে দেয় রোদ্দুরের আশা। যা আশ্বাস জোগায়, নিজে নিজে সেই ওমের বন্দোবস্ত করতে না পারলেও অসুবিধা নেই। কেন-না দারুচিনি দ্বীপের ভিতরে থাকা সবুজ ঘাসের উষ্ণতার মতোই কোথাও রয়ে গিয়েছে একফালি রোদের দেশ, কেবল খুঁজে পাওয়ার ওয়াস্তা। কুয়াশার চাদরেই যে শীতের রাত কেটে যায়, সেই রাতের বুকে লাইটহাউসের মতো জেগে থাকে ওই রোদেলা দেশ। শুধু দিন নয়, সম্পর্কও যখন ফুরিয়ে আসে, তখনও শীত নামে। তখনও রোদ চায় মানুষ। চায় ওম। ধু-ধু শৈত্যের মাঝে একলাটি সে দেখতে পায়,
“মায়ামমতার মতো এখন শীতের রোদ
মাঠে শুয়ে আছে
আর কেউ নেই”…
কেউ না থাকার শৈত্যে যে রোদ মমতার ওম বিছিয়ে দিতে পারে, তার জন্য আকুল অপেক্ষা। সকলের। কিন্তু চাইলেই কি সব মেলে? বারান্দায় রোদ্দুর তাই আর এসে উঠতে পারে না। কিংবা দেরি করা যেমন মানুষের জন্মগত অধিকার আর এ অধিকার পেতে তার কোনও দিনই দেরি হয় না; সেই অভ্যাসে গা ভাসিয়েই মানুষের কাছে রোদেরও এসে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। তবুও মানুষ অপেক্ষা করে থাকে। শৈত্যের আক্রমণের হাত থেকে কোনও একদিন অলৌকিক রেহাই তাকে এনে দেবে রোদ, সে অপেক্ষা। কোনও একদিন তার পায়ের তলায় আর মাথার উপরে বিছিয়ে থাকবে শৈত্যহীন এক উষ্ণ পৃথিবী, সেই অপেক্ষা। মনে মনে সে নিজেকেই ভরসা দেয়–
“কেমন আশার মতো মনে হয় রোদের পৃথিবী,
যতদূর মানুষের ছায়া গিয়ে পড়ে
মৃত্যু আর নিরুৎসাহের থেকে ভয় আর নেই
এ-রকম ভোরের ভিতরে।”
সব না-পাওয়ার হিমে এইটুকু আশাই আসলে রোদের অন্য নাম। আশা মরে গেলে যে হাড়-হিম-করা নিরুৎসাহ জাঁকিয়ে বসে, সেই জাড়ে জবুথবু হয়ে যায় মানুষ। এই ভয়ধরানো শীত সবসময় কেবল ব্যক্তিগত নয়, কখনও কখনও যৌথও বটে। আর কে না জানে, যৌথতায় জোর বাড়ে। সেই জোর পেয়ে ভয়ের শৈত্য আরামের আড়মোড়া ভাঙে। সে-ই তখন রোদ কেড়ে নেয়। ভয় পাওয়া মানুষ আরও তটস্থ হয়। গোটা জীবনে এমন যে কত একক বা যৌথ ভয়ের ধারাবিবরণী! যেন সবটা জুড়েই বিছিয়ে আছে এক চিরস্থায়ী শীতকাল। যেন আরেকরকম গণতন্ত্র।
গণতান্ত্রিক অভ্যাসে অবশ্য এহেন শীতের রমরমা। এই যেমন ধরুন না, ছোট বড় যে-কোনো ভোটে কত না সন্ত্রাসের গল্প! মানুষ তাতে ভয় পায়। আর ভীত হতে হতে ভয় পাওয়াই তার অভ্যাস হয়ে যায়। ফুরফুরে রোদ ভুলে যাওয়া সেই মানুষ ভয়াল শীতের মধ্যেই গুটিশুটি মেরে বসে। তার হাত বারেবারে ভয়ের উপরেই ছাপ্পা বুলিয়ে যায়।
তবু কি এই নিরাশার শৈত্যে কোনও একদিন রোদ পোহানোর আশা জেগে থাকে না কোথাও? তাই কোথাও কোথাও মানুষ জোট বাঁধে, তৈরি হয়। কিন্তু রোদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন জারি থাকলেও, রোদ আনতে চাওয়ার সফরকে সমর্থন করা যাবে কি যাবে না তা নিয়ে হাজারও দ্বিধা দ্বন্দ্ব সংশয়। ধরা যাক সেই রোদসফরে নাহয় ভুলভ্রান্তি অনেকরকমের। ধরা যাক শীতের বারান্দায় রোদ্দুর নাহয় এসে পড়লই না চাহিদামাফিক। তবু বারান্দা বিছিয়ে না দিলে সে কথা জানা যাবে কেমন করে! কিন্তু রোদ কেড়ে নেওয়া শীত আস্তে আস্তে মানুষকে বিশ্বাসই করিয়ে ফেলে যে মেঘলা দিনে একলা থাকাই তার অমোঘ নিয়তি। অতএব শীতের দাপটের সামনে কাঁথাকানিই সই। বিপন্ন প্রাণীর মতো রোদ্দুর একেবারেই উধাও। অমলকান্তিরাও অতএব মহাশূন্যের পথে। সমর্থন জোটানোর জন্য তারা জোট বাঁধলও যদি বা, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন তার আর জোটে কই!
শীতবেলার রোদ্দুর আসলে শ্রেণিহীন সেই স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন দেখায়, যা সকলের প্রতি সমবণ্টন করা যায়, কিন্তু যা কোনও দিনই মাটির বুকে সত্যি সত্যি নেমে আসে না।