শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। আর শীত মানেই তো পিঠে-পুলির পালা। স্বাদের আহ্লাদে নিপাট বাঙালিয়ানা উদযাপন। সেই গল্পই শোনালেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
পিঠে যা পড়ে, তাই সই। আর সইতে সইতেই আজকের বাঙালির ঝুলিতে বাঙালিয়ানা প্রায় বাংলার বাঘের মতোই বিলুপ্ত। তবে বাঘ থাক বা না থাক, বাঘের গায়ে মাখার মতো মাঘের শীত এখনও একটু আধটু উঁকি দিয়ে যায় এই বাংলায়। আর সেই শীতের হাওয়ায় চাদর জড়িয়ে বাঙালি মেখে নেয় টুকরো টুকরো স্মৃতির ওম। সেই স্মৃতির কোলাজে সামনের সারিতেই উঠে আসে পিঠে। এমনিতে মোয়া থেকে কেকের স্বাদে মুখ ডুবিয়েই বাঙালির শীতযাপন। উত্তুরে হাওয়া বইলেই বাঙালির দক্ষিণ হস্ত একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে পিঠের জায়গা আরও একটু স্পেশাল। নলেন গুড় আর চালগুঁড়োর যুগলবন্দির গন্ধ যেই নাকে আসে, সেই গন্ধে সওয়ার হয়েই পাড়ি দেওয়া যায় ফেলে আসা দিনকালে। গন্ধের মতো পুরনো স্মৃতির বাহন কমই আছে। আর তার সঙ্গে স্বাদ যুক্ত হলে তো কথাই নেই। যে মানুষটি কোনও এককালে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসেছিলেন নতুন দেশে, ওই স্বাদ-গন্ধ নিজের মধ্যে জারিয়ে নিতে নিতে তিনি বুনতে থাকেন স্মৃতির জাল। সে এক দ্যাশ আছিল… যেখানে মাঠভরা ধান, বাড়ির আঙিনা জুড়ে সার দেওয়া নারকেল গাছ, আর গোয়ালে থাকা কালো গরুর মিষ্টি দুধ… সেই এক ‘দ্যাশে’র স্বপ্ন তাঁর চোখ জুড়ে বসে। সে দেশ স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। যেখানে এই সময়েই ধান উঠত চাষির গোলায়। ধান মানেই তো ধন। সম্পদ। তাই এই সৌভাগ্যকে উদযাপন করার জন্য পৌষের শেষ দিনে পার্বণের আয়োজন। সেই পার্বণের স্মৃতিতে লেগে থাকে মায়ের আঁচলঘেরা মুখটি, আর নরম হাতে বানানো পিঠেপুলির তার। জীবনের শীতবেলায় পিঠে পায়েসের গন্ধ একাকার হয়ে যায় মায়ের টানের সঙ্গে। ঠিক যেমনটা হয় তাদেরও, যাদের জীবনে এখন শীত নয়, বসন্তের জোর আনাগোনা। আর সেই উদ্দাম বসন্তদিনের ঝোঁকে যাদের আটকে রাখতে পারেনি বাড়ির চারটে মাত্র দেওয়াল। সাত সমুদ্র আর তেরোটা নদী পেরিয়ে যারা ভেসে পড়েছে দূরের দেশের উদ্দেশে, কোনও এক বরফঘেরা শহরে বসে প্লাম কেক, ক্যান্ডিফ্লস, রেড ওয়াইনের হুল্লোড়ের ভিতরে হঠাৎ হঠাৎ তাদেরও নাকে ভেসে আসে মায়ের হাতের পাটিসাপটার ঘ্রাণ। সেদিন হয়তো অসময়েই জলতরঙ্গ বেজে ওঠে অনেক দূরের এক ঘুমন্ত বাড়িতে, পৌষপিঠের স্মৃতি বেয়ে মধ্যরাতে মাকে ছুঁয়ে ফেলা যায় হঠাৎ করেই।
আসলে যেসব স্মৃতি বুনে বুনে মানুষের নস্টালজিয়া বাসা বাঁধে, খাবারদাবার তার একটা বড় অংশ। আর বাঙালির ক্ষেত্রে সেই খাদ্যসংস্কৃতির অনেকখানিই জুড়ে রয়েছে মিষ্টি। মঙ্গলকাব্যের দিকে তাকাই যদি, সেখানে কখনও মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত ক্ষীর-সহ দুধের পঞ্চ পিঠা তৈরির গল্প শোনাচ্ছেন, তো কখনও বিপ্রদাস বলছেন ছয় বউমাকে নিয়ে চাঁদ সদাগরের পত্নী সনকার প্রচুর পরিমাণে পিঠে ও পায়েস রান্নার গল্পকাহিনি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সাধভক্ষণের সময় মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছে যে মেয়ে, তারও দাবি কিনা, ‘খাব নারিকেল তিলের পিঠা’। কিংবা অন্নদামঙ্গলে ব্রতপুজোর সময় ব্রাহ্মণদের শেষপাতে দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সেই পিঠে পুলি। আবার নীলাচলে মহাপ্রভুকে যা যা খাবার সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যেও রয়েছে রকমারি পিঠের সমাহার। এখান থেকে আরও একটা কথাও কিন্তু স্পষ্ট। উৎসব অনুষ্ঠান কি কোনও বিশেষ উপলক্ষ্যেই রান্না হচ্ছে পিঠে। কে না জানে, যা কিছু দুর্লভ, তারই দাম বাড়ে। পিঠেপুলি সারাবছর মেলে না বলেই বাঙালির জীবনে, বাঙালির স্মৃতিতে তার টান এত অমোঘ। আর বাঙালির ফেলে আসা স্মৃতির দিকে তাকালে যা কিছু কুড়িয়ে নেওয়া যায়, তা তো আসলে গল্পই। সেইসব গল্পের মধ্যেই রয়ে যায় কাঁকনমালা আর কাঞ্চনমালার কথাও। সে গল্পে কে রানি আর কে দাসী, তার মীমাংসা হয়েছিল পিঠে বানানোর ক্ষেত্রে দুজনের মুনশিয়ানা দেখে। যেখানে দাসী বানিয়েছিল আস্কে পিঠে, ঘাস্কে পিঠে, আর রানি বানিয়েছিলেন সরুচাকলি, চন্দ্রপুলি, আরও কত কী! এই যে ব্যক্তির সাপেক্ষে তাদের নিজস্ব রুচি ঢুকে পড়ল রান্নার ক্ষেত্রেও, পিঠেপুলির নকশায় জড়িয়ে আছে সেই একটুকরো ‘আমি’। আলপনার মতো, হাতের কাজের মতো, পিঠেও আসলে বাংলার ঘরের মেয়েদের গোপন নিজস্ব শিল্পবোধকেই তুলে আনে।
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
আসলে পুরনো বাংলায় মিষ্টি বলতে মানুষ বুঝত হাতে বানানো পিঠে পুলি পায়েস কিংবা নাড়ু মোয়াকেই। সেই মিষ্টি বানানো ফরমায়েশি নয় বলেই, পিঠে রান্নার মধ্যেও লেগে ছিল একরকমের যৌথতা। রোজকার থোড় বড়ি খাড়ার বাইরে এই যে বিশেষ রান্নার আয়োজন, রান্নাঘর আর ভাঁড়ারঘরেই গণ্ডি টেনে নেওয়া মেয়েদের জীবনে সেটুকুই বা কম কী! এও তো এক নতুন নির্মাণ, চেনা যাপনের বাইরে বেরোনোর অন্যরকম স্বাদ। সেই স্বাদ সমস্তটা দিয়ে মেখে নিতেই যেন সেখানে জড়ো হয়ে যেত গোটা বাড়ির অন্দরমহল। বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা’ মনে পড়ে? যে বাড়িতে নিত্যদিনের খাবারটুকু জোটাতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানেও পিঠে হওয়ার দিনটি যেন খোলা হাওয়ার মতো। স্নান সেরে, শুদ্ধ বস্ত্র পরে ‘ধিঙ্গি মেয়ে’-টির নারীত্বে প্রোমোশন পাওয়ার দিন। পিঠে গড়ার মধ্যে দিয়েই অজান্তে ঘটে যেত অমন কাছে টেনে নেওয়ার পালা। সে কাছে টেনে নেওয়ার ইচ্ছে কেবল অন্দরেই বাসা বাঁধত না, ছড়িয়ে যেত বাহিরমহলেও। তাই বাঙালি বাড়িতে পিঠে বানানোর পরিমাণ কম হত না কখনোই, বোধহয় আজও হয় না। সেকালে পিঠের ভাগ পেতেন আত্মীয় স্বজন থেকে পাড়াপড়শি সকলেই, এমনকি বাদ যেতেন না পরলোকগত পূর্বপুরুষেরা কিংবা বাস্তুদেবতাও। বাংলার পুরোনো লোকাচার এই যে বেঁধে বেঁধে থাকার যৌথ যাপনের পাঠ দিয়ে এসেছে, এখনও স্মৃতির সুতোয় তার গিঁট পড়ে আছে। তাই যেসব বাড়িতে এখনও পিঠে বানানোর চল রয়েই গিয়েছে, তাঁরা বাড়ির মানুষগুলির সঙ্গে সঙ্গেই গুনতিতে ধরে নেন চেনাজানা আরও কোনও কোনও মুখ। আজকের দিনে চাষের জমি থাক বা না থাক, পিঠে-র পরম্পরা রয়েই গিয়েছে। চিতই পিঠে, পাটিসাপটা, ডাল পিঠে, গোকুল পিঠে, রসপুলি, চন্দ্রপুলি, সরুচাকলি, বেণী পিঠে, চুটকি পিঠে— পিঠে অনেক। ওপার বাংলায় আবার মিষ্টি ছাড়াও নোনতা বা ঝাল পিঠের কমতি নেই, যেমন বরিশালের জনপ্রিয় পাকন পিঠা কিংবা মুগ পাকন পিঠা। মিষ্টি স্বাদের পিঠে, নিরামিষ পিঠের পাশাপাশি ডিম, শুঁটকি মাছ, মাংসের ব্যবহার নিয়ে পিঠের প্রণালীও অনেকরকম। তবে বহুরূপে থাকলেও পিঠে ভজনায় বাঙালির আলস্য নেই। মকরসংক্রান্তিতে পিঠে বানাতেই হবে, আর না বানালেও শীত এলে পিঠে খেতেই হবে, এই সংস্কারে এখনও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে বাঙালি। ব্রহ্মপুরাণ যতই ৫১ পীঠকে পিঠে-র উৎস বলে দাবি করুক, কিংবা মহাভারতেও যতই পিঠের উল্লেখ থাকুক না কেন, পিঠে পার্বণ, থুড়ি, পৌষ পার্বণের কপিরাইট কিন্তু একমাত্র বাংলারই।