শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। আর বাঙালির শীত মানেই বইমেলা, মেলা বই। আসরে নামার আগে বইদের সাজঘরও এই মরশুমই। স্বপ্নে ভর করে এই মরশুমেই ডানা মেলে কত না লিটল ম্যাগাজিন! পাতা ঝরার দিনে পাতা গড়ার সেই আয়োজনকে ফিরে দেখলেন সম্বিত বসু।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
পাতায় অক্ষর থাকলে শীত কেন, কোনও ঋতুতেই তা ঝরে পড়ে না। হ্যাঁ, হলুদ হয়। যত্ন-টত্ন না করলে পোকায় ধরে। ব্যক্তিগত মালিকানা কিংবা লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেলে একদিন গাছ-বিচ্ছিন্ন পাতার মতোই এসে পড়ে মাটিতে। বিক্রি-টিক্রি হয়। দাম বাড়ে। পাঠক ঠিকই খুঁজে নেয় তাকে। হাতফেরতা হয়। দেখা যায়, পাতায় লেখা রয়েছে পুরনো নাম, পুরনো দিন, আশীর্বাণী– বিয়ে-জন্মদিন-পুরস্কার কিংবা এমনিই, উপহারস্বরূপ। কখনও সখনও একটা-দুটো গোপন চিঠি, বইয়ের বিল, টেলিগ্রামের ছুটকো কাগজ, বাস-ট্রামের টিকিট। ফুল নয়, মানুষ বোধহয় পাতাকেই বেশি উপহার দিয়েছে বইয়ের আকারে। কিছু পাতা সার হয়, আর কিছু পাতা জীবনের সারকথা বলে। রোনাল্ড রস সরণির আশপাশ জুড়ে যে ময়দান, যে ময়দানের বুক চিরে চলে যেত কলকাতার অপরূপ ট্রাম, দেখবেন সেখানে অল্প হাওয়া দিয়েই পাতারা নেমে আসে গাছের পায়ে। খেলা করে। ওদের ‘মৃত’ বলে দাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না। হাওয়াই তাদের বাঁচিয়ে রাখে আরও কিছুকাল। শীতকালওয়ালাকে এখানে পাওয়া যাবে সারাবছরই। আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে এই রাস্তায় পাশে, দীর্ঘক্ষণ অচল হয়ে বসে থাকে। একটা দুটো পাতা, সারা বছর ঝরতে থাকে বলেই বোধহয় এই জায়গা সে বেছে নিয়েছে শীত বিক্রির জন্য।
বৈঠকখানা বাজার। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পাতারা। চলছে পরখ করা, দাম, দরদস্তুর, জিজ্ঞাসাবাদ। জানা যাচ্ছে, ওই যে যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন কিংবা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, যে-যুদ্ধে আমরা কেউ কেউ খুব উদাসীন, কেউ বা বিষণ্ণ– সেই যুদ্ধের জন্য বেড়ে গিয়েছে কাগজের দাম। পাতার মধ্যেই কেমন ঢুকে আছে বিশ্ব-রাজনীতি, যুদ্ধের ফলাফল! পুস্তানির জন্য কি অন্য কাগজ, প্রচ্ছদের জন্য? কোন কাগজ কত রিল নিলে পাতা নষ্ট হবে সবচেয়ে কম, সে হিসেবও চলছে নিবিড়। এদিকে এসে দাঁড়িয়েছে একদল। এরা লিট্ল ম্যাগাজিন, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। চোখেমুখে বিস্ময়। একটু দোনামোনাও করছে। কী কাগজ নেবে! এতদিন কাগজ বলতে তারা বুঝত– বড় পত্রিকার, খবরের কাগজ, ইশকুল-কলেজের রুক্ষ উত্তরপত্র, বাজার যাওয়ার ফর্দ কিংবা ডায়েরি, কখনও-সখনও ক্যালেন্ডারের পাতা। এখন কাগজের নানা নাম আর গড়ন শুনে বেজায় চিন্তায়! একটু ঝকঝকে পরিষ্কার পাতা নিতেই পারে, কিন্তু ট্যাঁকে কুলোচ্ছে না। কাগজের এহেন বৈচিত্রে ঐক্য আসতে দেরি হচ্ছে। প্রত্যেকেই কলেজ পড়ুয়া, কবিতা-গল্প লেখে, একজন ছবি আঁকে, পোস্টারও লেখে– সে-ই প্রচ্ছদ করবে এই কাগজের। এদের মধ্যে থেকেও কেউ বলে উঠবে, ‘যেটা কম, তাতেই হোক। যে কাগজে লেখা পড়া যাবে।’ এ কথায় বোধোদয়– বিবিধের মাঝে মহান মিলন ঘটে যায়। সাধারণ, অল্প মলিন বলাই চলে, এমন পাতা তারা বেছে নেয়। দূরান্ত থেকে আশ্চর্য রোদ এসে পড়ে সেই মলিন কাগজে। ১৪ কোটি ৯৫ লক্ষ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে রোদ যাকে বেছে নেয় পড়ার জন্য, তাকে কি আর মলিন বলা চলে?
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
প্রেসে এই সময় চলছে হুড়মুড়িয়ে টাইপ। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ। এর মধ্যে সেই কবি, যে ডিটিপি-ই করে, সে চমকে চমকে উঠছে আজ। উপন্যাসে নয়, গল্পে নয়, কবিতায়। মাত্র ১৬ পাতার একটা বই। কিন্তু টাইপ করতে তার ৩ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। সম্পাদক তাগাদা দিয়েছে ফোন করে। তবু। গদ্যে লেখা নয়, পদ্যের আঙ্গিকেই লেখা। বড় বেশি বিড়ি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে, বড় বেশি চা– স্রেফ এই পাণ্ডুলিপির জন্যই। জীর্ণ এই প্রেসের ছাদের দিকে উঠতে গেলে যে সিঁড়ি, ছাদের দরজা খুলে দিলে সেখানেও এসে পড়ে রোদ। সেই রোদে সে পিঠ দিয়েছে। আর পড়ছে। মনে হচ্ছে, এই জীবিকায় এসে এই তার দুরন্ত লাভ হল। কখনও এত লাভের মুখ সে দেখেনি। কখনও মনে হয়নি এই আনন্দদিন তার প্রায় একার, এখন, এই মুহূর্তে। কারণ এই পাণ্ডুলিপির পাঠক খুব কম জনই হবে, আর সেই অল্প সংখ্যার মধ্যে সে-ও একজন। বিকেলবেলা উড়ে আসছে চপ-মুড়ি। ছোট প্লাস্টিকের কাপে চা। দ্বিতীয় প্রুফে কী করে জানি অজস্র ভুল বেরিয়েছে উপন্যাসে। সব কারেকশন ধরে ধরে তুলে দেওয়ার পরও। এরপরও সে জানে, কেউ কেউ শেষবেলায় আসবে আস্ত একখানা বই নিয়ে। এবং কাজ চলবে গভীর রাত পর্যন্ত। বাড়ি? বাড়ি যাওয়া হবে না। কাঠের চৌকি, তার ওপর একটা প্রাচীন বালাপোষ। এ ঘরে রোদ ঢোকে না, তাই ঠান্ডা খানিক বেশি। কুছ পরোয়া নেই!
প্রকাশকের মাথায় হাত। দেব দেব করে লেখক তো ঝুলিয়ে মারল! বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে। এদিকে প্রচ্ছদশিল্পীও কাজ মেরে এনেছেন। কটা বইয়ের রিপ্রিন্টও চলছে। শীতটাও হঠাৎ করেই জব্বর পড়ল। প্রতিবারই লোকজন বলে, ধুস, পড়ছে না পড়ছে না, তারপর এমন পড়ান পড়ে! কতদিন আর সোয়েটারে নিজেকে আস্ত কচ্ছপের মতো গুঁজে ট্রেনের হাওয়া কানে লাগানো যায়। হাঁচিকাশির বাতিক আছে তো বটেই। এদিকে প্রেসও হুড়কো দিচ্ছে, ‘জলদি দিন, আর কিন্তু মেলার আগে দিতে পারব না।’ আগেই শুনিয়ে রেখেছে বাঁধাই ভালো হবে না তাড়াহুড়োয়। কিন্তু কী আর করা! পুরনো প্রেসে ধার রয়েছে তিন হাজার মতো, মেলায় বই বেচে তবেই ফেরত। আবার ধার। এই করেই তো চলছে। তবু থামানো যায় না। নতুন বইয়ের গন্ধ, ছাপার কালি, মেশিনের আওয়াজ। পাঠকের বিস্মিত চোখ, তালুর স্পর্শ, কথার চালাচালির জন্য এই একটাই তো সরল সময়। বিল লিখতে লিখতে আরেকটু হাতের লেখা ভালো করার ইচ্ছে জিইয়ে থাকে বছর বছর।
আর এসবের থেকে দূরে– ওই যে লেখক। সে এত কিছুর মধ্যে কোথায়? নেই হয়ে আছে। পাওয়া যাচ্ছে না। নিরুদ্দেশ। সে তার কাঠের টেবিলে, উন্মুখ, ঝুঁকে আছে সাদা পাতায়। গাছ তো কাঠের টেবিলেরই পূর্বজন্ম। তার ওপর সে নিয়ে এসেছে লেখার পাতাকে। গাছকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে পাতা। লেখক ছাড়া এ কাজ, আর কে করতে পারত বলুন!