শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। ‘শীতকাতুরে’ বাঙালির গ্লিসারিনের খুশবু ভরা শীত-শীত স্নানঘরের গল্প শোনালেন যশোধরা গুপ্ত।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
আজ থেকে প্রায় নয় দশক আগে লেখা বুদ্ধদেব বসু-র ‘পৌষ তাদের ডাক দিয়েছে’ প্রবন্ধটি এতদিন যে কেন পড়িনি, এই ভেবে নিজেকে খুব খানিক ধিক্কার দিলাম। তাঁর হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫) বইটা পূর্বেও পড়েছি বটে, কিন্তু তখন এই প্রবন্ধটি কোনওভাবে বাদ পড়েছিল। আজকে বই খুলে পড়তে গিয়ে এই বাক্যগুলির দিকে চোখ আটকে গেল।
ঋতুর প্রভাব আমার মনের উপর আশ্চর্য্যরকম প্রবল। ঋতুগুলোকে আমি প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি— সমস্ত সত্তায় গৃহীত কোনো অখণ্ড অভিজ্ঞতার মত। বিশেষ-কোনো ঘটনাকে আমি সব চেয়ে ভালো মনে করতে পারি তখনকার ঋতুর আবহ দিয়ে। কোনো মেঘলা দিনে, হাওয়া যেদিন এলোমেলো, চাপা উত্তাপে আকাশ আনত, সেদিন আমার জীবনে যা ঘটেছিলো, পরবর্ত্তী কালে যদি ঠিক সে-রকম কোনো দিন আসে, ঠিক সেই অভিজ্ঞতা আবার নতুন করে ফিরে আসবে আমার মনে। অনির্দ্দেশ্য কোনো গন্ধে, হাওয়ার কোনো হঠাৎ-খেয়ালে, অতীত আমার জীবনে আবার বেঁচে ওঠে।
এই অংশটি পড়ে পুরনো বইয়ের বিবর্ণ পৃষ্ঠায় পেনসিল দিয়ে হাসিমুখ এঁকে রাখি। ঋতু, রং আর গন্ধ এই তিনের মধ্যে আমার অতীতের অসংলগ্ন সব টুকরোগুলি ছড়িয়ে রয়েছে। এর কোনও একটি টুকরোর সামান্য অনুরণনে পুরনো অ্যালবামের পাতাগুলি খুলে যায়।
শীতকাল পড়ার সময়টা আমার ছোটবেলা বড় বাজে লাগত, আকাশে-বাতাসে এই সময় পরীক্ষার ভীতিরেণু ওড়াউড়ি আরম্ভ করেছে। চারপাশে প্রচুর মশা। দিনের আলো থাকতে দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ফেলা সেকালে যেমন হতাশাউদ্রেককারী মনে হত, একালেও তাই। শীতের দুপুরে বাগানে বসে আমার দাদাইয়ের যত্নে ছাড়িয়ে দেওয়া কমলালেবু খেতে খেতে মনে যেটুকু শান্তির ভাব উদয় হত, ভূগোল-বইয়ের কথা কল্পনা করে তা অন্তর্হিত হতে বেশি সময় লাগত না। তবু কিছু মায়া কি আর থাকবে না এই ধূসর ঋতুর! এক জায়গায় অনন্তকাল বসে থাকার আরাম, তা পরীক্ষার পড়া করার ছল করে হলেও, আমার কাছে এক অবর্ণনীয় আরামের বস্তু। স্নানে আমার অরুচি নেই। তবে গায়ের গরমে, বিছানার যে অংশটিকে বহু কষ্টে উষ্ণ করেছি, তাকে ত্যাগ করে শীতের দিনে বাথরুমে পৌঁছে যাব, এমন মনোবল আমার নিয়মিত হত না। তবে রোজকার কাহিনি এমন ধূসর একঘেয়ে ছিল না। টিভিতে সেসময় শীতকাল পড়লেই একটি গান নিয়মিত বাজত, “এল শীতের রুক্ষ শুষ্ক দিন, প্রিয় ত্বকের যত্ন নিতে, চেসমি গ্লিসারিন”। আমি প্রায় নিঃসন্দেহে বলতে পারি, যাঁরা আমাদের বয়সি, অথবা আমাদের চাইতে বয়সে বড়, একদা এই গান নিয়মিত শুনেছেন, এই শব্দগুলি কানে গেলে সুর সমেত তাঁরা আজও স্পষ্ট গেয়ে ফেলতে পারবেন গানটি। যা হোক, এই গান শুনি আর মনে মনে ভাবি এ বাড়ির কেউ এই সাবান ব্যবহার করে না কেন! পিয়ার্সের জনপ্রিয়তা যেহেতু প্রশ্নাতীত, আমাদের পরিবারও সেই দলে। আমাদের বাড়ির উলটো দিকের বাড়িতে ববি নামের একটি মেয়ে থাকত, সেকালে বাংলায় ছয়বার ঋতু পরিবর্তন হত, কিন্তু দুপুরবেলায় স্নান এবং আহারান্তে ববির সাজগোজ করে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে গলির এ প্রাপ্ত-ও প্রান্ত হেঁটে বেড়ানোয় কোনও পরিবর্তন হত না। এমনই এক শীত-মধ্যাহ্নে আমি বিনাস্নানে বাড়ির রকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত একখানি বিবর্ণ উলের চাদর জড়িয়ে বসে আছি, ভাবছি আজকেও যদি স্নানকে ফাঁকি দেওয়া যায় কোনওমতে, এমতাবস্থায় সামনে এসে দাঁড়ায় ববি। আমি দৃশ্যত এমনই উশকোখুশকো ছিলাম, যে আমার পাশে বসায় সম্ভবত তার কিঞ্চিৎ দ্বিধা কাজ করেছিল। তাকিয়ে দেখি যথেষ্ট শীতেও তার গায়ে এক শৌখিন জামা, শীত-পোশাকের কোনও প্রশ্নই নেই। দেখে শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে আমার হাড় হিম হয়ে আসে। তার গা থেকে ভুরভুর করে কীসের মনোরম সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল। কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করি কী, “কী মেখেছিস গায়ে?” সে স্মার্টনেস এবং অবহেলার এক চমৎকার মেলবন্ধন গলায় এনে উত্তর দেয়, “চেসমি গ্লিসারিন, কেন তোদের বাড়িতে গ্লিসারিন সাবান কেনা হয় না নাকি?” বলেই হনহন করে হেঁটে চলে যায় ববি! আমিও প্রাথমিক কিংকর্তব্য ভাব কাটিয়ে বাড়ি ঢুকে আসি এবং স্নানের ঘরে চলে যাই দ্রুত। সেখানে পিয়ার্সও নেই, একখানি মার্গো গ্লিসারিনের ফিকে সবুজ বর্ণের সাবান, তবে সুগন্ধ রয়েছে দিব্যি। সেসময়ে স্নানঘরে গিজারের প্রশ্ন ছিল না। লোহার বালতিতে জল ভরে, ইমার্শন হিটারে গরম করে পুনরায় সেই ভীতিপ্রদ স্থানে ফিরি, সারা স্নানঘরে উষ্ণ কুয়াশা, সাহসে ভর করে স্নান সারি, সুগন্ধী মোলায়েম সাবান মেখে নিই। আর সত্যি বলতে কী, স্নান করে যে আরাম হয়েছিল, তার জন্য ববির প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি। সেই শুরু, তারপরে জীবনের পরবর্তী যতগুলি বছর কেটেছে, যতই শীত পড়ুক, স্নানে যতবার ঢিলেমি এসেছে, ববির মুখ মনে করে নিজেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছি। স্নান, স্নান-পরবর্তী ময়েশ্চারাইজার লোশন, বড়দিনের কাছাকাছি বাড়িতে বানানো কেক; ইদানীং আর পরীক্ষা-টরীক্ষার বালাই নেই, কর্মক্ষেত্রেও এসময় খানিক ছুটির পরিবেশ— তবু এসবের মধ্যে, শীত পড়লেই মনে পড়ে পথের পাঁচালী উপন্যাসের সেই বৃদ্ধার কথা, নাম ইন্দির, বাড়ি নিশ্চিন্দিপুর। ও পাড়ার রামনাথ গাঙ্গুলির বাড়ি গিয়ে যিনি শীতের একখানা ‘বস্তর’ চেয়েছিলেন, তারপরে অনেক হাঁটাহাঁটি ঘোরা-ফেরার পরে কুষ্টিয়ার রাঙা একখানি সুতি চাদর জুটে যায় সেবার।
ইন্দিরকে দেখে ও পাড়ার দু-একটি দুষ্টু মেয়ে বলেছিল, “উঃ, ঠাকমাকে রাঙা কাপড়ে যা মানিয়েচে! ঠাকমার বুঝি বিয়ে!”
আরও শুনুন: শীতকাল এলেই বোরোলীনের সংসার
একদা একখানি চেসমি গ্লিসারিনের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলাম, শীতে তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু মনে হয়নি, অথচ আজ পর্যন্ত কেনা হয়ে ওঠেনি সে সাবান, শেষ দুপুরের নরম শীতের মতো আজও বিজ্ঞাপনের গানখানি কানে বাজে; ইদানীং শীত পড়লে স্বপ্ন দেখি, শীতকালে যাদের দেহ-মন স্তব্ধ হয়ে আসে, গায়ে দেওয়ার কাপড় নেই, অথবা মনে শান্তি নেই, এই শীতে ইন্দিরের লাল নরম, উষ্ণ সুতি-চাদরখানি তাদের সকলকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিক, রাঙা কাপড়ে তাদেরকেও মানাবে খুব।