শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। শীত মানেই শিউলিদের গাছ-কাটা, খেজুর রসের মিঠে স্বাদ, নলেন গুড়ের গন্ধ। ‘শীতকাতুরে’ বাঙালিকে সেই গল্প শোনালেন সৌরভ হোসেন।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
যখন আমার অভাবী মা, বাবার একখানা লুঙ্গি দুমড়ে গিঁট বেঁধে সোয়েটার বানিয়ে পরিয়ে দিতেন আমার গায়ে, আর আমি কালহা মাটিতে খালি পায়ে সেই ফজর-ভোরে পুয়ালের আগুনে আগুন পোহাতাম, তখন অঘ্রানের মাঠে পোয়াতি হয়ে উঠত আমন ধান। কাস্তে হাতে নাবালে নেমে যেতেন বাবা। পাশের বাড়ির তৈয়মচাচা লাঙল কাঁধে বলদ জোড়া হাঁটিয়ে ‘হাট’ ‘হাট’ করে চলে যেতেন মাঠে। আর গাছাল ফড়ু খেজুর গাছে পাতা খেজুর রসের ঠিলিটা পেড়ে নিয়ে যাওয়ার পর, ‘ঘাটি’তে লাগানো খেজুরপাতার জিভের দিকে লোলুপ জিভ বের করে অপেক্ষা করতে থাকা আমার মুখে টস করে একবার ঝরে পড়ত গাছারস; তখনই আমি টের পেতাম শীত এসে গেছে আমাদের গাঁয়ে। আমাদের মাঠ-মাঠানে। পাড়-পগার জুড়ে নেমে আসা সে-শীতের রং সাদা। ধবধবে সাদা। এই শীতই যখন আলো ফুরিয়ে রোদ ঝরিয়ে নেমে যায় রাতের গহিনে, তখন সেই সাদা কুয়াশার রাতকে আমার মা বলেন, ‘আন্ধার ভুরকুট’। সে অন্ধকারে বিলের পাড়ে জুবুথুবু হয়ে থাকে জাড়। আর তার মাঝে পিঠ কুঁজো করে দাঁড়িয়ে থাকে খেজুর গাছগুলো। মাঠে যেন তখন নাকে নথ, কানে দুল আর কোমরে বিছে পরে বাড়ি আসার জন্য ছটফট করছে পাকা ধান। সোনা রঙের সে ধানের ওপর শেষ পড়নের রোদ পড়লে পুরো মাঠ সোনালি হয়ে ওঠে। কুটুম আসার অপেক্ষায় প্রস্তুত হয় দিঘল খৈলেন। উশখুশ করে ধানের গোলা। কুঠি-দালান। দুর্বো ঘাসের ডগায় যে শিশিরবিন্দু জমে তার স্পর্শে শীতের আমেজ নেয় জমিন। এই জমিনেই জীবনের সব অঙ্ক, সব রসায়ন। ইহকাল-পরকালের সব ইবাদত। গাছাল ফড়ু শেখদের দুনিয়াদারিও এই জমিনি ইবাদতে। এক দিকে পিঠ, এক দিকে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছগুলোয় উঠে তাদের পেট থেকে রস নিংড়ে নেওয়া। এই ইহকালীন রস নিংড়ানোতেই যেন তাদের ‘মাগফেরাত’। ‘হাশর’-এর মাঠে শেষ বিচারের দিনে তাদের ‘নেকি’ (পুণ্য)-র সাক্ষ্যদাতা। দুনিয়াদারির সমস্ত ‘গুনাহ’ যেন এই খেজুর পাতার ফাতনা দিয়েই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়! কার্তিক থেকে ফাল্গুন, এই পাঁচ মাস ফড়ুর মতো গাছালরা জাড়কে কেটে কুয়াশাকে ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে খেজুর গাছে ঠিলি পাতেন। সন্তানের মতো আদর-সোহাগ করেন বলেই তো আমরা সে খেজুর রসের স্বাদ পাই। নলেন গুড়ের তৃপ্তি পাই; পিঠে-পুলি, ক্ষীর-পায়েস বানাই; সেসব স্বাদ-সোহাগ ছাড়া যে শীত বড্ড বেমানান!
শীত এলেই শিউলিদের মহাকাব্য রচনা শুরু হয়ে যায়। কার্তিক থেকে ফাল্গুন, এই পাঁচ মাস তাদের কাছে মহাকাব্যিক মাস। এই শিউলিদের আবার অঞ্চলভেদে ভাষাগত নামও আলাদা আলাদা। কোথাও ‘গাছাল’ কোথাও ‘শিউলি’। পরনের লুঙ্গিটাকে নেঙ্গুট মেরে, পায়ে ছাঁন (দড়ির বাঁধন) লাগিয়ে, কোমরে পাকানো দড়ির ছাঁন বেঁধে হাতে গাছকামানো পাশনি নিয়ে তারা যেন নতুন অবতার! ঘচঘচ করে যখন গাছ কামানোর শব্দ হয়, তখন যেন দুনিয়াতে নতুন কোনও সুরের আগমন হয়। খেজুর রস বা নলেন গুড় পাওয়ার আগে শিউলিদের কতকগুলি ধাপের মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়। যেন আলাপ গৎ পেরিয়ে অপূর্ব এক রাগবিস্তার।
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
কার্তিক মাস পড়তেই শুরু হয়ে যায় ‘ছাড়ান পর্ব’ অর্থাৎ গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করা। তারপর ‘চাঁচা’– যেখান দিয়ে রস নির্গত হবে সে জায়গাটার ছাল তোলা এবং ‘ঘাটিমারা’– চাঁচা জায়গাটার মাঝখানে একটা গর্ত করে খেজুর পাতার জিভ তৈরি করে লাগানোর পর্ব। এসব হয়ে গেলে শুরু হবে ‘লাগান’ পর্ব, অর্থাৎ রস ঝরতে লাগলে একটা আংটা করে ঠিলি ঝোলানোর কাজ। ‘লাগান’ শুরু হলেই শিউলিদের চোখমুখ পালটে যায়। ‘খেজুর পাতার জিভ দিয়ে টসটস করে রস ঝরার মতো তাদের চোখ-মুখ দিয়ে আনন্দ ঝরে পড়ে’। তারপর মাঝে মাঝে চলে ঠিলি পাতা বিরত রাখা, যাকে বলা হয় ‘শুকান’ পর্ব। ‘শুকান’ পর্বের পর যে রস বের হয়, তার চাহিদা খুব। সাধারণত গাছ মালিকরা এই রস দাবি করে থাকেন। একে বলা হয় ‘শুকান কাঠের রস’। ঠিলি বোঝাই রস বাঙ্গিতে ঝুলিয়ে বয়ে আনা হয় বাড়িতে।
তারপর চলে আর এক মেহনতি দুনিয়াদারি। হাড়খাটুনি শ্রম। বাড়ির মেয়েদের আঁচল গোঁজারও সময় থাকে না তখন। খাটুনিতে গা-গতর ডুবিয়ে দেন। পালার পর পালা মাটির ঠিলি মাজতে মাজতে তাঁদের হাতে ঘটা পড়ে যায়। কোমর-পিঠ লেগে যায়। সারাদিন গনগনে আখার পাড়ে পড়ে থাকতে হয়। কড়াইয়ে গাছারস ঢেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে জ্বাল দেওয়ার পর্ব। জ্বাল দেওয়ার মাঝে মাঝে লোহার মস্ত ছাঁকনি দিয়ে ‘গাদ’ তুলে ফেলতে হয়। কড়াইয়ে সাদা ফেনার মতো ‘গাদ’ জমতে শুরু করলেই শিউলি বা শিউলিগিন্নিদের মুখটা চিরিক করে হেসে ওঠে। ‘গাঁদ’ তুলে ফেলতেই চোখে পড়ে পোড়া বাদামি লালচে রঙের পাকানো ল্যাপ্টো গুড়! যেন সদ্য প্রসব হওয়া সন্তান! তখন শিউলিদের চোখে-মুখে বেহেস্তি তৃপ্তি! সারা শরীরে খুশির ঢেউ খেলে ওঠে। সেই বেহেস্তি আনন্দে তাঁরা ঠেংনে দিয়ে গুড়ের ‘বিচমারা’ শুরু করে দেন। তখন কড়াই থেকে ম ম করে নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধ। এক কড়াই রস থেকে দশ কেজি মতো গুড় তৈরি হয়। সে গুড় রাখা হয় আলাদা আলাদা মাটির হাঁড়ি বা বড় বড় ভাঁড়ে। তারপর চলে তার বাণিজ্যকরণ। গুড় তো বিক্রি হয়ই, গুড় দিয়ে বানানো সন্দেশ, ভিড়ে, মুড়কি আর নাড়ুরও ব্যাপক চাহিদা থাকে। তখন শিউলিদের সংসারে ভরা সুখ আসে।
আসলে শীত মানেই তো একটু আয়েশ, একটু রসেবশে থাকা।