লেপের আদর। কাঁথার ওম্। শীতের বেলায় বাঙালির দুই-ই ভারি প্রিয়। তবু লেপ আর কাঁথা কি হল? ঠিক যেন এই সমাজেরই মতো। বৈষম্যের ওঠা-পড়া জড়িয়ে আছে সর্বাঙ্গে। শীতের আয়নায় লেপ-কাঁথার বাইনারি যেন সমাজের পুঁজিপতি-প্রলেতারিয়েতের দ্বন্দ্বেরই রূপক। সেদিকে ফিরে তাকালেন অর্পণ গুপ্ত। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
তেমন একটা শীত না এলে বড়বাবু মাঠে নামেন না। বড়বাবু মানে লেপ। পেল্লায় বপুর হেভিওয়েট বড়বাবু বাঙালি জীবনে আসেন ওই মাসখানেকের জন্যই। এ মুলুকে শীতকাতুরে বাঙালির শীতযাপনের চার মাসের মধ্যে শেষ ডিসেম্বর আর প্রাক জানুয়ারি পর্ব বাদ দিলে, বাকি সময়টা মধ্যবিত্ত ময়দান কাঁপিয়ে দেন কাঁথা। ছোটো শীত-সেজো শীত-মেজো শীত অবধি মোটামুটি তিনিই আমাদের দোস্তজি।
কাঁথার সঙ্গে এ নিদারুণ সখ্যের কারণ অনেক। ধরা যাক, নরম তুলতুলে কাপড়ের গায়ে থাকা সেই সব অস্বস্তিকর ফুটো– যেখানে মাঝরাতে বুড়ো আঙুলের নিঃশব্দ যাতায়াত, সেলাইয়ের খুঁট থেকে বেরিয়ে থাকা সুতো, নিজেকে নারকেল পুর ভেবে পাটিসাপটার মতো লেপটে নেওয়ার আরাম, জানলার ফাঁক দিয়ে শিরশিরে হাওয়া এলে আরেকটু জড়িয়ে ধরা– মনকেমনের এ সমস্ত রাতে কাঁথা তো কেবল উপশম নয়, তার চেয়েও ঢের বেশি বন্ধু। শীতের সালতামামির ভেতর যে ক’টা লাইন কাঁথার জন্য বরাদ্দ, সে হিসেবের ভেতর যেন আমাদেরও অবাধ প্রবেশ– বন্ধুর ডাকনামের মতোই আপন সে।
অথচ, বড় টুর্নামেন্ট এলে যেমন আনকোরা প্রতিভাদের সরিয়ে মাঠে নেমে পড়ে দুঁদে ব্যাটার, তেমনই শীত বাড়লে এসব বন্ধুতাকে সাইডলাইনে সরিয়ে মাঠে নামেন লেপ বাবাজি। ধারে-ভারে-বনেদিয়ানায় যেন রাজপরিবারের বড় ছেলে। লেপের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঢুকে যাওয়ার আগে একদফা সম্ভ্রমপর্ব– পরিপাটি ভাঁজ খুলে, রোদে বিছিয়ে, কাপড়ের জামা পরিয়ে তবেই তার আগমন। ঘুমের মাঝে বেমক্কা লাথি, গা থেকে সরে গেলে বিরক্তিতেও টেনে নেওয়া আদর– এসবের বালাই নেই; ভারী লেপবাবাজি যেন আমাদের অভিভাবক। বহু চেষ্টাতেও তিনি সরবেন না, শরীরে বিছিয়ে রাখবেন আভিজাত্যের ওম।
জীবন কিংবা সমাজের এই দীর্ঘ শীত আমাদের ভেতরে এনে দেয় সেই আশ্চর্য বোধ, যেখানে লেপ-কাঁথা শব্দজোড়া পাশাপাশি উচ্চারণ করলেও দুটিকে একই স্তরে রাখতে পারি না কিছুতেই। সাম্যবাদের গানেও খানিক উঁচুনিচু নোটস– বিত্তের দাঁড়িপাল্লায় অসম ভার নিয়ে বসে থাকা দু’জন। পথে-ঘাটে-ফুটপাথে থাকা কাঁথা, আর মধ্যবিত্তের খাটের পাশে থাকা লেপ দুই ভিন্ন সত্তা নিয়ে আসে, কখনও এই প্যারাডক্স দৃশ্যমান করে দেয় সামাজিক ও খানিক চলিত নির্মাণকেও। শীত চলে যাবার আগে, মাঘের শেষবেলায় কিংবা প্রাক-ফাল্গুনে লেপ বাবাজি বিদায় নেন। ম্যাচ প্রায় জিতিয়ে পাড়ার টেনিদা, ঘনাদারা যেমন তাচ্ছিল্যভরে উইনিং স্ট্রোক মারার জন্য ব্যাট এগিয়ে দেন কচিকাঁচাদের– তেমনই লেপবাবাজি ব্যাটন পাস করেন কাঁথাকে।
ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে নাকি লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা যায়। অবশ্য ইএমআই যুগে লাখ টাকা আর স্বপ্ন নেই, আর থাকলেও তা দেখার জন্য ছেঁড়া কাঁথা বাধ্যতামূলক নয়। কাঁথার ছেঁড়া-ফুটো-রংওঠা চেহারা আর আমাদের অল্পবিস্তর মানিয়ে নেওয়ার যে মিথোজীবিতা, যা কিনা নিদারুণ মধ্যবিত্ত ভাবনার একেবারে সমান্তরাল– তার সঙ্গে লেপের মোলাকাত ক্ষণিকের– ক্ষমতাসীন রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে যেমন মাঝে মাঝে দেখা হয় চুনোপুঁটিদের– তেমনই। সামাজিক অবস্থানের নিরিখে উচ্চবিত্তের কেবলই লেপ, নিম্নবিত্তের সহায় কাঁথাই– কিন্তু মধ্যবিত্ত এই দুয়ের সঙ্গেই এক অদ্ভুত সিচুয়েশনশিপে থাকে। রাজবাড়ির খাবারের স্বাদও সে চায়, আবার মাঝে মাঝে ফিরে আসতে চায় মাটির দাওয়ায়।
কাচের দেওয়ালের বাইরে থেকে শপিং মলের ভেতর ব্র্যান্ডেড ঘড়ি কিংবা জ্যাকেট দেখে আমাদের যে শিরশিরে ইচ্ছে, শীতের কুয়াশার ভেতর তাকালে আমরা কি দেখতে পাব– কাঁথাও আমাদেরই মতো ভাবছে যে, সে-ও একদিন দর পাবে শীতের ময়দানে, তার রাংতার মতো চিকচিক স্বপ্ন জুড়ে কি থেকে যায় বড় হয়ে ওঠার খিদে, দড় হয়ে ওঠার মোহ? নাকি কাঁথার এই নির্মল বন্ধুতায় প্রাচুর্যের প্রবেশ ঠেকিয়ে দিয়েছে সে নিজেই? মধ্যবিত্তের নীতিবোধ নিয়ে সে হয়তো থেকে যায় যথার্থ বন্ধুর মতোই। লেপের সঙ্গে আমাদের যে স্বাভাবিক দূরত্ব, সমাজের উঁচুতলার মানুষদের প্রতি মধ্যবিত্তের যে তির্যক দৃষ্টি– বৈভবের ভেতর যেমন সে মাঝে মধ্যে পায়চারি করে ফের ফিরে আসে নিজের আরামে– কাঁথাও নিজেও সে মর্যালিটির-ই অংশ হয়ে গেছে এত বছরে। এই আলগা শীতের দেশে লেপ আর কাঁথার এহেন সম্পর্কের আয়নায় আমাদের বৃহত্তর সমাজের উঁচুনিচু টিলাগুলি কুয়াশা সরিয়ে দৃশ্যমান হয়ে যায় কেবল…