মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
এই পর্বে থাকল, সত্যজিৎ রায়ের রামদর্শন। ‘সোনার কেল্লা’র চলচ্চিত্রায়ণে, যোধপুরে মুকুলের সঙ্গে আসল ডক্টর হাজরার আবার দেখা যখন হবে, তখন ‘মন মেরা রাম রাম রচে’ চলে রাজস্থানের লোকসাংগীতিক আবহে। এরকমই বহু চমকপ্রদ অনুষঙ্গ সত্যজিতের তাঁর গল্পে এবং সিনেমায়।
লিখেছেন, প্রিয়ক মিত্র।
‘লালমোহন গাংগুলী নাম তো আর চলে না, তাই নিলুম ছদ্মনাম– জটায়ু। ফাইটার। কী ফাইটটা দিয়েছিল রাবণকে বলুন তো!’ – রাবণকে ফাইট দেওয়া পাখির নামে যিনি ছদ্মনাম রাখেন, তিনি কী লেখেন? যাকে কেতাবি ভাষায় বলে, ‘পাল্প ফিকশন’। যদিও ফেলুদার ভাষায় তা নেহাতই ‘থোড় বড়ি খাড়া’ থেকে ‘খাড়া বড়ি থোড়’-এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। তার নেপথ্যে খুঁজে দেখলে সেই সময়কার চটি গোয়েন্দাগল্প বা স্বপনকুমারীয় পাল্পের প্রতি সত্যজিৎ রায়ের দৃষ্টিভঙ্গিও খানিক চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। জটায়ু পৌরাণিক চরিত্র, সীতাকে রক্ষায় ব্যর্থ হলেও তার মাহাত্ম্য নেহাত কম নয়। কিন্তু সত্যজিতের জটায়ুর প্রখর রুদ্র কখনওই ফেল করে না। গণ্ডাখানেক গুলি খেয়েও তার অটুট থাকাকে খোদ ফেলুদাও ‘বাড়াবাড়ি’ বলে অভিহিত করে ফেলে একবার।
যুগের সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদার পাঠ বদলেছে, তার মধ্যেও খানিক ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’-এর আভাস অনেক পাঠক পেয়ে থাকেন। পাল্প বরং এখন অনেক সাদরে চর্চিত হয় সমান্তরাল সাংস্কৃতিক পরিসরে। তাই প্রখর রুদ্র সত্যি থাকলে, বলা যায় না, দীপক চ্যাটার্জির মতো তারও কোনও পুনঃপাঠ সম্ভব হত। তবে এক্ষেত্রে ধর্তব্য বিষয়টা খানিক অন্য। জটায়ুর পৌরাণিক সূত্র এই পাল্পের চূড়ান্ত অবাস্তবতার প্রতিনিধি হয়। সত্যজিৎ যেখানে জটায়ুর সহচর লেখকের নাম রাখেন ‘নিশাচর’, সেখানে বোঝাই যায়, ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’ বা ‘সাহারায় শিহরণ’-এর লেখকের নাম জটায়ু রাখাটাও তৎকালীন পাল্পীয় বা তথাকথিত জনপ্রিয় চটি গোয়েন্দার পরিসরে খুব একটা বেমানান বলে মনে করেননি সত্যজিৎ। তাই ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে মন্দার বোস যখন ‘সাহারায় সীতাহরণ’ বলে মশকরা করে, এবং জটায়ু ওরফে লালমোহন ‘আপনি রসিক লোক মশায়’ বলে কেল্লা কাঁপিয়ে হেসে ওঠে, তখন রামায়ণ যেন আর পঞ্চম বেদ থাকে না, বরং তৎকালীন ‘অমর চিত্রকথা’-র মতো রঙিন হয়ে ওঠে, যার পাশে থাকতে পারে ‘ইন্দ্রজাল কমিকস’-এর বাহাদুর, এমনকী হয়তো বা ফ্যান্টম, ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশগর্ডন-রাও। তাই পুরাণ আর পাল্প সেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: যুদ্ধের দিনে প্রেম… কম্বনের রামায়ণ যেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা
কিন্তু সবসময়ই কি এত সহজে সত্যজিৎ পুরাণকে পড়েছেন? পাঠক ‘খগম’ গল্পটি মনে করে দেখুন। সেই গল্পে রবি বর্মার পেন্টিং থেকে উঠে আসা অভিশাপরত দুর্বাসা মুনির চিত্রকল্প ভেসে উঠেছিল কথকের সামনে, যখন আক্ষরিক অর্থেই ইমলিবাবার দুধকলা দিয়ে পোষা কেউটে সাপ বালকিষণকে অকারণেই হত্যা করে বসে ধূর্জটিবাবু, এবং অভিশাপ দেওয়ার জন্য হাত উঠে আসে সেই সাধুবাবার। আর ধূর্জটিবাবু ধীরে ধীরে মানুষের খোলস ছেড়ে সেই সাপ হয়েই ফিরল ইমলিবাবার গর্তে; যেভাবে মহাভারতের গল্পে তপস্বী খগমের অভিশাপে সহস্রপাদ মুনি হয়ে গিয়েছিলেন ঢোঁড়া সাপ। প্রায়শ্চিত্তর সে এক আশ্চর্য পৌরাণিক সমাপতন। সেই সত্যজিৎই ‘মিঃ শাসমলের শেষ রাত্রি’-তে এক হত্যাকারীর সঙ্গে মোলাকাত ঘটিয়েছেন আজীবন তার হাতে নিহত সবক’টি প্রাণীর। হত্যার ফল পাওয়ার এই অনিবার্যতাই তো তাড়া করেছিল দশরথকে, মৃগয়ার নেশায় যখন তিনি অন্ধমুনিকে মৃগ ভ্রমে বধ করে বসেন, এবং তাঁর অভিশাপ থেকে সূচনা হয় এমন এক আখ্যানের, যা শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী নিয়ন্ত্রণ করে যাবে একটি ভূখণ্ডের অবচেতনকে। মহাভারতেও পাণ্ডুকে যে অভিশাপ বহন করতে হল, তাও তো এই মৃগয়ার ভুলেই। ঋষি কিন্দম ও তার স্ত্রীর মিলনকালে তাদের হরিণযুগল বলে তির চালিয়েছিলেন পাণ্ডু।
‘দার্জিলিং জমজমাট’-এর বিরূপাক্ষ মজুমদার অভিশপ্ত হননি। মধ্যপ্রদেশের নীলকণ্ঠপুরে বাঘ ভেবে সুধীর ব্রহ্ম নামে এক কবিরাজি গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করা ইতিহাসের অধ্যাপককে গুলি করে মারার ফল তাকে অভিশপ্ত হয়ে ভুগতে হয়নি, দশরথের মতো পুত্রশোকও তাকে সরাসরি পেতে হয়নি। কিন্তু তার ছেলের নৈতিক অধঃপতন হোক বা পুরনো পাপের, আদি অপরাধের ভার নিয়ে ন্যুব্জ হয়ে বাঁচা- এর মধ্যে কোথাও হয়তো অভিশাপ ছিলই, যেমন ছিল ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এর মহেশ চৌধুরীর। হত্যা কখনও ক্ষমাহীন হয়নি সত্যজিতের গল্পে, তা প্রায়শ্চিত্ত হয়ে ফিরে এসেছে। অন্ধমুনি বা কিন্দমের অভিশাপ ছিল, উত্তরসূরির প্রতিশোধ ছিল না। কিন্তু রমেন ব্রহ্ম ওরফে রজত বসু বিরূপাক্ষর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এসেছিল। আবার মহেশ চৌধুরীর ছেলে অরুণেন্দ্র, যে কিনা আদত অপরাধী, সে একজন আদ্যন্ত শিকারি। মৃগয়াতেই তার সুখ। আর তার যাবতীয় ঈর্ষা ও আতঙ্ক যাকে নিয়ে, সেই বীরেন ওরফে কারান্ডিকার পলাতক বাঘ সুলতানকে নিজের বন্ধু বলে বিশ্বাস করে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
কাজেই মৃগয়া বা শিকারের সঙ্গে অপরাধের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রাখেন সত্যজিৎ। সে ডাঃ মুনসী হোক বা ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-র মহীতোষ সিংহরায়- এরা দিনের শেষে অপরাধী না হলেও, অপরাধের বীজ এরাই রোপণ করে। যেভাবে দশরথের মৃগয়া তাকে দিয়েছিল চূড়ান্ত আঘাত, যেভাবে মায়ামারীচ সোনার হরিণ সেজে রাম আর লক্ষণকে টেনে নিয়ে যায় সেই মৃগয়ার নিয়তিতেই, যার ফলে অবধারিত হয়ে ওঠে সীতাহরণ। উচ্চবিত্ত রাজেন মুনসির তাড়ার চোটে গাড়ি চালাতে গিয়ে যে গাড়িচালক মেরেছিল এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পথচারীকে, তার নাম সত্যজিৎ আশ্চর্যভাবেই রেখেছিলেন রঘুনন্দন। এর নেপথ্যে কোনও গূঢ় পৌরাণিক ভাবনা কাজ করেছে, এমন ভাবা নিশ্চিত বাতুলতা, কিন্তু শিকারি রাজেন মুনসীর জন্যই সেই অপরাধের বোঝা চেপেছিল রঘুনন্দনের ঘাড়ে, যেভাবে দশরথের শিকার রামকে দিয়েছিল বনবাসের নিয়তি। মহীতোষ সিংহরায় নিজের শিকারি সত্তা বজায় রাখতে গিয়ে শোষণ করে গিয়েছিল বন্ধু শশাঙ্ক ও সেক্রেটারি তড়িৎকে।
মৃগয়া তাই অনিবার্য ভবিতব্য নির্ধারণে, যেভাবে ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’-র মেজকুমার নিজেই শিকার হয় মানুষখেকো শ্বাপদের, তারিণীখুড়োকে সে বাঘ আক্রমণ করে না কোনওভাবেই, তারিণীখুড়োও তাকে শিকার করে না, মানুষখেকো বাঘ শেষমেশ মরে বজ্রাঘাতে। এর নেপথ্যেও এক বাবাজির ভবিষ্যৎবাণী ও ওষুধের ভূমিকা ছিল অব্যর্থ, যদিও অন্ধমুনিকেও যেমন মৃত্যুবরণ করতে হয়, তেমন সেই বাবাজিও বজ্রপাতের প্রকোপ এড়াতে পারেন না ও শেষমেশ নেহাতই মানুষী সর্দিজ্বরে কাবু হয়ে পড়েন। কিন্তু মিথুনরত ক্রৌঞ্চযুগলের দিকে ছুটে যাওয়া ব্যাধের ঘাতক তির না থাকলে ‘মা নিষাদ’-এরও তো জন্ম হত না বাল্মীকির মুখ থেকে। শিকারই তাই কথনের শুরু, এবং প্রায়শ্চিত্তরও পূর্বসূত্র। ‘বৃহচ্চঞ্চু’-র তুলসীবাবুর নামের সঙ্গে তুলসীদাসের কোনও সম্পর্ক ছিল না হয়তো, কিন্তু সেও গাছগাছড়া সংগ্রহ করত, শিকারে বিশ্বাসী ছিল না। তাই সে প্রাগৈতিহাসিক পাখি অ্যান্ডাগ্যালর্নিসকে হত্যার কথা ভাবেও না, তার নরমেধ বন্ধ করে স্রেফ তাকে আমিষ ছাড়িয়ে, যার জন্য সে নিজেও ছাড়ে মনসুরের দোকানের পরোটা-কাবাব, একমাত্র যা তাকে আশ্চর্য করত। সঙ্গী প্রদ্যোতবাবু ‘বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের হিড়িক’-এ শিকার ছাড়লেও বন্দুক ধরেই মুখোমুখি হয়েছিল চঞ্চুর, তুলসীবাবু সেই জুরাসিক প্রাণীকে কিন্তু পরম মমত্বে কেবল বলেছিল, ‘অনেক লজ্জা দিয়েছিস আমাকে, আর দিসনি।’
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
ইমলিবাবা বা ডুমনিগড়ের উদাস বাবার মতো উদার অবিশ্যি সত্যজিৎ মছলিবাবা ওরফে আবলুসবাবার ক্ষেত্রে হননি। তোপসে লিখে রেখেছিল মছলিবাবার আসরে গাওয়া ভজনের দু’লাইন, ‘ইতনি বিনতি রঘুনন্দন সে/ দুখ দ্বন্দ্ব হামারা মিটাও জ্বি’। রামচন্দ্রর কাছে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’-র মতো এই প্রার্থনা যেখানে ঘটছে, তা বস্তুত এক অপরাধের আখড়া। চলচ্চিত্রে যদিও রেবা মুহুরির কণ্ঠে মীরার ভজন ‘মোহে লাগি লগন গুরু’ ও ‘হে গোবিন্দ রখু সরানা’ ব্যবহৃত হয়েছিল। আবার ‘সোনার কেল্লা’, যে গল্পে জটায়ুর আবির্ভাব, তার চলচ্চিত্রায়ণে, যোধপুরে মুকুলের সঙ্গে আসল ডক্টর হাজরার আবার দেখা যখন হবে, তখন ‘মন মেরা রাম রাম রচে’ চলছে রাজস্থানের লোকসাংগীতিক আবহে। মুকুল জখম হাজরাকে দেখে ‘দুষ্টু লোক’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে, কারণ নকল ডক্টর হাজরা তাকে তেমনটাই শিখিয়েছে।
আদতে কারা ‘দুষ্টু লোক’, তা নকল ডক্টর হাজরা-রা চিরকালই নিজের স্বার্থে শেখায় মুকুলদের। সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্র-জীবনের প্রথমার্ধে ‘দেবী’ বানিয়েছিলেন কেন, তার জবাব তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল বলে শেষ দিকের সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন সেকথা। যে ‘রিলিজিয়াস ডগমাটিজম’-এর বিরুদ্ধে তাঁর স্বর ছিল তীব্র, তা জীবনের শেষে আরও সোচ্চার হয় ‘গণশত্রু’-তে, বা ‘আগন্তুক’-এ মনমোহনের সাংগঠনিক ধর্মের বিরুদ্ধে মন্তব্যে, আটের দশকের শেষ থেকে নয়ের দশকের গোড়ায়, যখন ভারতীয় রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িক তোলপাড় চলছে নানাভাবে। এই দুই বিন্দুর মাঝে ‘সোনার কেল্লা’-র সেই দৃশ্যে পূর্বজন্মের স্মৃতিকাতর মুকুল সেই লোকায়ত রামভজনায় মজে যায় ও সত্যিকারের ‘দুষ্টু লোক’-দের চিনতে পারে না সহজে। চেনে অবশেষে, যখন ভবানন্দ বা নকল ডক্টর হাজরা, যে অপধর্মের বেসাতি বসাতে দ্বিধা করে না, জাতিস্মরের বয়ানে ভর করে লোভের বশে ছুটে আসে রাজস্থান, সে বন্দুক ধরে ময়ূরের সামনে, সেই শিকারি চেহারার কল্যাণেই মুকুলের কাছে মুখোশ খুলে যায় আসল ‘দুষ্টু লোক’-এর।