মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
এই পর্বে থাকল, রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় রাম ও রামায়ণের সন্ধান। কোনও এক বিশেষ ধর্মের সাপেক্ষে নয়, দেশের সংস্কৃতি ছুঁয়ে রামায়ণকে বুঝতে চেয়েছিলেন কবি। চেয়েছিলেন রামায়ণকে ছুঁয়েই দেশের আঁতের কথাটিকেও চিনে নিতে।
লিখেছেন বিবস্বান।
আমাদের যৌথ মনস্তত্ত্বে মহাকাব্য যে কখন কীভাবে ঢুকে যায় তা আমরা জানি না। রামায়ণের বিষয়টাও তা-ই। আমরা কেউ হয়তো খুব ছোটোবেলায় দাদু দিদার কাছে রামায়ণের গল্প শুনেছি। কেউ টিভিতে রামায়ণ দেখেছি। কেউ আবার পড়েছি ‘ছবিতে রামায়ণ’। কিন্তু ঠিক কবে আর কীভাবে আমাদের মধ্যে রামকথার একটা স্রোত ঢুকে পড়েছে আমরা জানি না। যুগ থেকে যুগান্তরের পথে রামকথা এইভাবেই সঞ্চারিত হয়েছে। এইখানেই মহাকাব্যের মজা। আমাদের প্রত্যেকেরই একজন নিজস্ব রাম আছেন। তাঁর খানিকটা আমরা পেয়েছি গল্পের উত্তরাধিকারে। বাকিটা তৈরি করে নিয়েছি নিজেদের কল্পনায়। রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। রবীন্দ্রনাথের পাঠে কেমন ছিল রাম আর রামায়ণ? সেইটাই একটু খুঁজে দেখা যাক।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
‘ঋজুপাঠের সামান্য উদ্ধৃত অংশ’ পড়েই বালক রবীন্দ্রনাথ মায়ের কাছে গর্ব করেছিলেন- “পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি”। এ নিছক এক গর্বিত বালকের অহংকার নয়। আদি কবির উত্তরাধিকার নিজের মধ্যে ধারণ করে নেওয়ার মুহূর্ত। অনেক সমালোচকই মনে করেছেন যে বাল্মীকির রামকথায় রাম আসলে দেবতা নন। বহুগুণসম্পন্ন একজন মানুষ। মহাকাব্যের নায়ক। তাঁর দেবত্ব পরবর্তী প্রক্ষেপ। এই বাল্মীকির রামকেই রবীন্দ্রনাথ মনে মনে বহন করবেন আজীবন। তাই তাঁর কাছে রাম কখনও দেবতা হয়ে উঠবেন না। ‘নরচন্দ্রমা’ হয়েই থাকবেন।
যদিও বাল্মীকির রামায়ণের আগেই রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন কৃত্তিবাস। পৌঁছে গিয়েছিল রাম পাঁচালি। বইয়ের অক্ষরে নয়। মৌখিক পরম্পরায়। যেভাবে মহাকাব্য ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে, সেইভাবেই। শৈশবের সন্ধেবেলাগুলোয় রবীন্দ্রনাথ ব্রজেশ্বরের কাছে শুনেছিলেন গোটা সাত খণ্ড রামায়ণ। কিশোরী চাটুজ্যের পাঁচালির সুরও ছিল তার সঙ্গে।
‘ছেলেবেলা’য় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কৃত্তিবাস শোনার কথা। আর ‘জীবনস্মৃতি’তে এসে তিনি লিখলেন কৃত্তিবাস পড়ার কথা। সেই মেঘলা বিকেলে কোনও এক দূর সম্পর্কের দিদিমার ‘মার্বেলকাগজ-মণ্ডিত কোণছেঁড়া-মলাটওয়ালা মলিন’ বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক কান্নার স্মৃতি। রামায়ণের কোনও করুণ বর্ণনা পড়ে বালক রবীন্দ্রনাথের চোখে জল এসেছিল। তাই সেই দিদিমা বইটি তাঁর থেকে কেড়ে নিয়ে যান। অনেক পরে ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘যাত্রাপথ’ কবিতায় কি অন্যভাবে ফিরে আসবেন এই দিদিমা? সেখানে বটতলায় ছাপা কৃত্তিবাসী রামায়ণের মলাটকে রবীন্দ্রনাথ উপমিত করেছিলেন দিদিমায়ের বলিরেখাময় ললাটের সঙ্গে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা,
দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা।
আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগি তাহার মলাট
দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট।
এ তো শুধু উপমা নয়। এই রামায়ণের প্রতি আপামর ভারতবাসীর অভিব্যক্তি। এইখানে মহাকাব্য যেন হয়ে ওঠে আমাদের ফেলে আসা প্রজন্ম। পূর্বপুরুষ আর পূর্বনারীদের মতোই যার সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক।
রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ শোনা আর পড়ার স্মৃতি ধরে আমরা বুঝে নিতে চাইছি ঠিক কোন রামকে ভালোবেসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি কি কোনও ক্ষত্রিয় বীর? তিনি কি কোনও দেবতা? নাকি তিনি আমাদের খুব কাছের এমন মানুষ, যাঁর ওপর অভিমান করা যায়! যাঁর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মনখারাপের সুর।
পঞ্চভূতের ‘অপূর্ব রামায়ণ’ প্রবন্ধটি শুরু হয়েছিল বারোয়াঁ রাগিণীর উল্লেখে। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের পঞ্চভূতের প্রবন্ধগুলো পাঁচজন চরিত্রের মধ্যে হওয়া দার্শনিক আড্ডা। সেই আড্ডার এক চরিত্র ব্যোম বলেছিল, আমাদের দেশীয় রাগিণীগুলোর মধ্যে একটা পরিব্যাপ্ত মৃত্যুশোক আছে। যা কিনা বারবার বলে যায় এই সংসারে কেউই থাকবে না। সব চলে যাবে। সবাই চলে যাবে।
সেই প্রসঙ্গেই আড্ডার আরেক চরিত্র ক্ষিতি বলেছিল অপূর্ব রামায়ণের কথা। “রাজা রামচন্দ্র- অর্থাৎ মানুষ- প্রেম-নামক সীতাকে নানা রাক্ষসের হাত হইতে রক্ষা করিয়া আনিয়া নিজের অযোধ্যাপুরীতে পরমসুখে বাস করিতেছিলেন। এমন সময় কতকগুলি ধর্মশাস্ত্র দল বাঁধিয়া এই প্রেমের নামে কলঙ্ক রটনা করিয়া দিল।”
আর রাজা করলেন কী? শাস্ত্রের কানাকানিতে প্রেমকে বিসর্জন দিলেন মৃত্যুতমসার তীরে। ধর্ম কি এইভাবেই মানুষের থেকে ভালোবাসা কেড়ে নেয়? সেই কথাই রূপকের আড়ালে বলা রইল রামায়ণী কথায়? আর সেই ছেড়ে দেওয়ার দুঃখই লুকিয়ে রইল আমাদের দেশীয় রাগিণীগুলির মনে?
সোনার তরীর ‘পুরস্কার’ কবিতায় সীতাহরণের পর রামের আর্তক্রন্দনের ছবি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রেমিকের সেই শোক দেখে সমস্ত অরণ্য যেন মুখ কালো করে চুপ করে চেয়েছিল সেইদিন। কিন্তু এমন ভালবাসার পরিণতি কী হল? সেই সীতাকেই নীরব অভিমানে, রাজসভায় রঘুরাজকে শেষ প্রণাম করে চলে যেতে হয়। দুঃখ, তা সে যতই বড়ো হোক, তার কোনও চিহ্ন কোথাও থাকে না। সীতার পাতালপ্রবেশের পর, দ্বিধা ধরণী আবার জোড়ে। দণ্ডকবনে ফুল ফোটে। সরযূর তীর আবার সবুজ হয়ে ওঠে। সেই একদিনের যন্ত্রণার ছবি মুছে যায় পৃথিবীর বুক থেকে।
শুধু সে দিনের একখানি সুর
চিরদিন ধ’রে বহু বহু দূর
কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর
মধুর করুণ তানে;
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসংগীতে
বাজে মানবের কানে।
রবীন্দ্রনাথের চোখে রামায়ণ সেই বেদনার রাগিণী। তাই তো ‘চৈতালি’ কাব্যগ্রন্থের ‘বনে ও রাজ্যে’ কবিতায়, সারাদিনের রাজকাজ শেষ করে ক্লান্ত রাম যখন শোয়ার ঘরে আসেন, তখন তাঁর মনে হয়,
আজি আমি রাজ্যেশ্বর, তুমি নাই আর,
আছে স্বর্ণমাণিক্যের প্রতিমা তোমার।
নিত্যসুখ দীনবেশে বনে গেল ফিরে,
স্বর্ণময়ী চিরব্যথা রাজার মন্দিরে।
রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ এই চিরব্যথার গল্প বলে। সেখানে রাম মানুষ। রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য।
আসলে তো শোক থেকে জন্ম নেয় শ্লোক। সেই ক্রৌঞ্চ মিথুনের গল্পই রামায়ণের গল্পের প্রতিধ্বনি। সেই গল্পই আভাস দিয়েছিল, দাম্পত্যসুখের নিবিড়তম আরম্ভের সময়েই দাম্পত্যসুখের দারুণতম অবসান ঘটবে। তারপর যে রাম-রাবণের যুদ্ধ, তা তো উপলক্ষ্য মাত্র। রবীন্দ্রনাথের পাঠে রামায়ণ আসলে মানবিক সম্পর্কের গল্প। “পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতিপত্নীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য” কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে রামায়ণ তাই দেখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চোখে রামায়ণ কেবলমাত্র বীররসের কাব্য হয়ে থাকেনি।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: রায়সাহেবের রামদর্শন– থাকেন ‘জটায়ু’, দুষ্টু লোকের পাশেই চলে রামের ভজন
রামায়ণের আরেক ধরনের ব্যাখ্যা আমরা পাই ‘জাভা যাত্রীর পত্রে’। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “কৃষির হলবিদারণরেখাকে যদি কোনো রূপ দিতেই হয় তবে তাকে পৃথিবীর কন্যা বলা যেতে পারে। শস্যকে যদি নবদূর্বাদলশ্যাম রাম বলে কল্পনা করা যায় তবে সেই শস্যও তো পৃথিবীর পুত্র। এই রূপক অনুসারে উভয় ভাইবোন, আর পরস্পর পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ।”
আজকে রাম নিয়ে অতি-সংবেদনার সময়ে রবীন্দ্রনাথের এই পাঠ অনেকের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে যেমন চিরবেদনার কাব্য বলে মনে করেছেন, তেমনই মনে করছেন, রামায়ণের মধ্যে এক কৃষি-সভ্যতার ধ্বংসের রূপক রয়েছে।
“কৃষির ক্ষেত্র দুরকম করে নষ্ট হতে পারে- এক বাইরের দৌরাত্ম্যে, আর-এক নিজের অযত্নে। যখন রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গেল তখন রামের সঙ্গে সীতার আবার মিলন হতে পেরেছিল। কিন্তু, যখন অযত্নে অনাদরে রামসীতার বিচ্ছেদ ঘটল তখন পৃথিবীর কন্যা সীতা পৃথিবীতেই মিলিয়ে গেলেন। অযত্নে নির্বাসিতা সীতার গর্ভে যে-যমজ সন্তান জন্মেছিল তাদের নাম লব কুশ। লবের মূল ধাতুগত অর্থ ছেদন, কুশের অর্থ জানাই আছে। কুশ ঘাস একবার জন্মালে ফসলের খেতকে-যে কিরকম নষ্ট করে সেও জানা কথা। আমি যে-মানে আন্দাজ করছি সেটা যদি একেবারেই অগ্রাহ্য না হয় তা হলে লবের সঙ্গে কুশের একত্র জন্মানোর ঠিক তাৎপর্য কী হতে পারে, এ কথা আমি পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করি।”
‘পরিচয়ে’র ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’, ‘সাহিত্যে’র ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ প্রভৃতি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের একটা নৃতাত্ত্বিক পাঠও তৈরি করতে চাইছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, “রামচন্দ্র বানরগণকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদিগকে দলে লইয়া বহু দিনের চেষ্টায় ও কৌশলে এই দ্রাবিড়দের প্রতাপ নষ্ট করিয়া দেন; এই কারণেই তাঁহার গৌরবগান আর্যদের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছিল।” বলা বাহুল্য এই দ্রাবিড়রাই রবীন্দ্রনাথের পাঠে রাক্ষস। এক বেদনার ইতিহাসের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন কৃষি সভ্যতার দ্বন্দ্ব। তাই হয়ত রক্তকরবীর ভূমিকাতে কর্ষণজীবী আর আকর্ষণজীবী সভ্যতার দ্বন্দ্ব বোঝাতে তিনি রাম-রাবণের রূপক তুলে আনবেন।
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ পাঠের বহুস্বরিকতা রয়েছে। এই বহুত্বই তো ভারতবর্ষের আঁতের কথা। আসলে রবীন্দ্রনাথ “রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে” বুঝতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে রামায়ণ কোনও দেবতার মহিমা প্রচারক ধর্মগ্রন্থ নয়। তাই তাঁর ‘বনবাস’ কবিতার কথক মায়ের কাছে আবদার করতে পারে, লক্ষণের মতো ভাই এনে দেওয়ার। ঠাকুরদাদার মতো মুনি ঋষি, গুহক মিতা আর দুধভাত খাওয়া হনুমানকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করতে পারেন বালকের কল্পরাজ্য। অনুবাদ করতে পারেন কবীরের। যিনি কিনা ‘রাম আর আল্লার সন্তান’। রবীন্দ্রনাথ খোঁজেন সেই রামকে যিনি ভক্তির সুতোয় গেঁথে দিয়েছিলেন, আর্য আর অনার্য সভ্যতাকে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: যুদ্ধের দিনে প্রেম… কম্বনের রামায়ণ যেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা
বাল্মীকি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “যতক্ষণ তিনি রামের চরিত্র সৃজন করিতেছিলেন ততক্ষণ তিনি নিজেই রাম হইয়াছিলেন ও তাঁহার নিজের মহান ভাবে নিজেই মোহিত হইয়া গিয়াছিলেন ।” এই মহান ভাব আসলে সমগ্র ভারতবর্ষের। কারণ রবীন্দ্রনাথের চোখে রামায়ণ আর ভারতবর্ষ আলাদা নয়। সেই ভারতবর্ষরূপ রামায়ণ অথবা রামায়ণরূপ ভারতবর্ষের কাহিনি বুনে উঠেছিল কবির যে মনোভূমিতে, তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে হয়ে ওঠে অযোধ্যার চেয়ে সত্য।
কবিদের মনই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে আসল রামমন্দির।