ভারতবর্ষের অন্তরে বাস রাজা রামচন্দ্রের। ভারতবাসী আবহমান কাল ধরেই অন্তরের আনন্দ আর শ্রদ্ধা দিয়ে রামচন্দ্রের ললাটে সূর্যতিলকই এঁকে দিয়েছে। রামচন্দ্রের জন্মতিথির উদযাপন তাই হয়ে উঠতে পারত ন্যায়-নীতি-ন্যায্যতা এবং সেই অর্থেই ধর্মের উদযাপন। কিন্তু সম্প্রতি যেন সেই রামের থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন মূর্তির রামলালা। এই রাজনীতির প্যাঁচপয়জারের মধ্যে সেই রামচন্দ্রকে আমরা হারিয়ে ফেলব না তো?
সূর্যদেব এখন যথেষ্ট প্রখর। উষ্ণতার আঁচ যথেষ্টই। তবে তার পরত যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে রামনবমীর ‘রাজনৈতিক উদযাপনে’। আমিষ বনাম নিরামিষ, মন্দির বনাম মন্দির নয়, মিছিল বনাম কেন মিছিল – ইত্যাদি অজস্র দ্বন্দ্বে যেন কাহিল রামচন্দ্রের পুণ্য জন্মতিথি।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: যুদ্ধের দিনে প্রেম… কম্বনের রামায়ণ যেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা
অথচ এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল? বোধহয় নয়। ভারতবর্ষের অন্তরে বাস রাজা রামচন্দ্রের। সেই রামচন্দ্র, যাঁকে ঘিরে মহাকাব্যের কবি ‘পরিপূর্ণ মানবের আদর্শচরিত’ রচনা করতে চেয়েছিলেন। মহাকাব্য একটি সভ্যতার অন্তরের সামগ্রীকে ধারণ করে বলেই তা মহাকাব্য। তা কখনই কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না বা একরৈখিক মতবাদে ইন্ধন জোগায় না। ভারতবর্ষ চিরকাল ধরে রামচন্দ্রকে গ্রহণ করেছিল সেভাবেই। তিনি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন। তাঁকে প্রশ্ন করা যায়, সমালোচনা করা যায়। আবার তাঁর পক্ষের যুক্তিগুলো খতিয়েও দেখা যায়। রামচরিত্রের মধ্যেই তাই ছিল ‘বিরোধের মধ্যে শান্তি’ এবং ‘পরিপূর্ণ পরিণামের মধ্যে সমস্ত খণ্ডতার সুষমা’। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’র ভূমিকা লিখতে গিয়ে তাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, “রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতাপুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায়, স্বামীস্ত্রীতে যে ধর্মের বন্ধন, যে প্রীতি-ভক্তির সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। দেশজয়, শত্রুবিনাশ, দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচণ্ড আঘাত-সংঘাত, এই-সমস্ত ব্যাপারই সাধারণত মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন ও উদ্দীপনার সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই; সে যুদ্ধঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্যপ্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষমাত্র। পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতিপত্মীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছে। এইরূপ ব্যক্তিবিশেষের প্রধানত ঘরের সম্পর্কগুলি কোনো দেশের মহাকাব্যে এমনভাবে বর্ণনীয় বিষয় বলিয়া গণ্য হয় নাই।” ভারতবর্ষ যে যুগে যুগে রামচরিত্রকে আশ্রয় করেছে, তা এই কারণেই। বিস্তীর্ণ এই দেশের অঞ্চলভেদে তাই রামায়ণের ভাষ্যেও খানিক খানিক বদল এসেছে। বহু রকমের রামায়ণ প্রচলিত এবং তা মানুষের হৃদয়কেই স্পর্শ করে। রাম চরিত্রের অধিষ্ঠান তাই ভারতবাসীর হৃদয়ের সাম্রাজ্যে, সেখানেই তিনি রাজা। রবীন্দ্রনাথ তাই বলবেন, “রাম যে একই কালে আমাদের কাছে দেবতা এবং মানুষ, রামায়ণ যে একই কালে আমাদের কাছে ভক্তি এবং প্রীতি পাইয়াছে, ইহা কখনোই সম্ভব হইত না যদি এই মহাগ্রন্থের কবিত্ব ভারতবর্ষের পক্ষে কেবল সুদূর কল্পলোকেরই সামগ্রী হইত, যদি তাহা আমাদের সংসারসীমার মধ্যেও ধরা না দিত।” রামচন্দ্র ভারতের সেই আশ্রয়, যেখানে, ‘দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।’
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
এই রামচন্দ্রের জন্মতিথির উদযাপন তাই হয়ে উঠতে পারত মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণতার প্রতি মানবের যে আকাঙ্ক্ষা তারই উদযাপন। হয়ে উঠত পারত ন্যায়-নীতি-ন্যায্যতা এবং সেই অর্থেই ধর্মের উদযাপন। বহুকাল ধরেই দেশে রামের এই জন্মতিথি পালন হয়ে থাকে। নানা উপায়ে আর উপাচারে নরচন্দ্রমার কথা স্মরণ করেন মানুষ। ‘রামলীলা’ও হয় নিয়ম করে। অর্থাৎ রামায়ণের যে সারকথা তারই কীর্তন হয়, নাটকের আঙ্গিকে। যুগে যুগে মানুষ সেই অভিনয়ের সাক্ষী থাকেন, আর অভিনয় পেরিয়ে সন্ধান করেন স্বয়ং রামকে।
সম্প্রতি যেন সেই রামলীলার থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন মূর্তির রামলালা। বহু আইনি জট পেরিয়ে তিনি এখন অযোধ্যার মন্দিরে অধিষ্ঠিত। তবে, তাঁকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি যেভাবে আবর্তিত হচ্ছে তা খানিক অস্বস্তিরই। শাসক এবং বিরোধী দুজনেরই অভিযোগ যে, রামকে কেন্দ্র করে রাজনীতি হচ্ছে। তা নিয়ে আকচাআকচি, পরস্পরের প্রতি আক্রমণের বহরও তুঙ্গে উঠছে। এর সঙ্গে আবার জুড়ে গিয়েছে আমিষ-নিরামিষের দ্বন্দ্ব। এই বিরোধও আসলে সাংস্কৃতিক এবং সেই অর্থে রাজনৈতিক। এমন নয় যে, রামচন্দ্রের জন্মতিথির উদযাপন দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। যিনি মহাকাব্যের নয়, তাঁর ক্ষেত্রে এমন খণ্ডিত পরিসর কল্পনা করা সম্ভবও নয়। তবে, এ দেশের অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির তারতম্য ঘটে। সেই ভিন্নতা মেনেই চলে রামের আরাধনা। তবে, সাম্প্রতিক রাজনীতি যেন রামচন্দ্রকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে একটি একমুখী রূপ দিতে তৎপর। তার জন্যই ক্রমাগত বাধছে ঠোকাঠুকি। আর যত এই গোলমাল বাড়ছে, তত যেন রামচন্দ্র হয়ে উঠছেন রাজনৈতিক। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময়ের রাজনীতির বিভিন্ন পরিসর তাঁকে আশ্রয় করছে ব্যক্তিগত মত প্রতিষ্ঠায়। তার দরুন কী কী হচ্ছে বা হতে পারে তা সমাজবিজ্ঞানের গবেষকরা বলবেন। তবে, এটুকু বলা যায় যে, এর ফলে মহাকাব্যিক রামচন্দ্রকেই ক্রমশ সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: রায়সাহেবের রামদর্শন– থাকেন ‘জটায়ু’, দুষ্টু লোকের পাশেই চলে রামের ভজন
শোভাযাত্রা, রথযাত্রা, প্রভাতফেরি, ভজন, লীলাকীর্তনে রামের স্বরূপ যুগে যুগে দেশের মানুষের মনে ফুটে উঠত। ভারতবাসী আবহমান কাল ধরেই অন্তরের আনন্দ আর শ্রদ্ধা দিয়ে রামচন্দ্রের ললাটে সূর্যতিলকই এঁকে দিয়েছে। রাজনীতির এই প্যাঁচপয়জারের মধ্যে সেই রামচন্দ্রকে আমরা হারিয়ে ফেলব না তো? শঙ্কা শুধু এটুকুই।
ছবি: ব্রতীন কুণ্ডু