মিঠে শীতে পিঠের স্বাদ বাঙালির একান্ত আপন অভিজ্ঞান। কৃষিপ্রধান বঙ্গের এই অপূর্ব খাবার শুধু রসনাতৃপ্তির কাজটিই যে যুগ যুগ ধরে করে চলেছে তা নয়, বহন করে চলেছে সংস্কৃতির সূত্রগুলিও। বাংলার কৃষক আর বাংলার রমণীর শ্রম-কল্পনার সাক্ষ্য বহন করছে বাংলার পিঠেপুলি। শীতের এই মরশুমে সেই পিঠের পাঁচালি শোনালেন খাদ্য-সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ও সামরান হুদা, শুনলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়। পড়ে শোনালেন চৈতালী বক্সী।
শীত মানেই পিঠে পুলির মরশুম। পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে, পাকন পিঠে, আঁদোশা, গড়গড়া, পাতসিজা থেকে শুরু করে মুগসামলি, মুগতক্তি, রসবড়া, ভাজা পুলি, ক্ষীরপুলি, দুধপুলি, মুগপুলি… ঘ্রাণে নয়, নামের বাহারেই যেন অর্ধেক ভোজন সারা। আসলে, কথায় বলে, পৌষমাস নাকি লক্ষ্মীমাস। খাদ্যসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ দেবাশিস মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, পৌষ পার্বণ আসলে ধান, তথা শস্যের উৎসব। কৃষিজীবী বাংলায় এই সময়েই ধান উঠত চাষির গোলায়। ধান মানেই তো ধন। সম্পদ। তাই এই সৌভাগ্যকে উদযাপন করার জন্য পৌষের শেষ দিনে পার্বণের আয়োজন। আর সেই পার্বণের প্রধান পর্ব হিসেবে চলে এসেছে নতুন ধানের চাল আর নতুন গুড় দিয়ে পিঠে বানানোর রীতি। তবে কেবল বাড়ির লোকেরাই নয়, সেই পিঠের ভাগ পান আত্মীয় স্বজন থেকে পাড়াপড়শি সকলেই, এমনকি বাদ পড়েন না পরলোকগত পূর্বপুরুষেরা কিংবা বাস্তুদেবতাও। এভাবেই ভাগ করে নেওয়া, আর বেঁধে বেঁধে থাকার যৌথ যাপনের পাঠ দিয়ে এসেছে বাংলার পুরোনো লোকাচার। সেই পরম্পরাকেই ধরে রেখেছে পৌষপার্বণও।
আরও শুনুন: শুনে নিন প্রচেত গুপ্তর গল্প, পাঠে দেবশঙ্কর হালদার
পৌষপার্বণের প্রধান নৈবেদ্য হল সরা পিঠে বা চিতই পিঠে। তবে কেবল চিতই পিঠেই নয়, আরও কতরকমের পিঠের নাম উঠে আসে বাংলার পুরনো গল্পে। বাঙালির ফেলে আসা স্মৃতির দিকে তাকালে যা কিছু কুড়িয়ে নেওয়া যায়, তা তো আসলে গল্পই। সেইসব গল্পের মধ্যেই রয়ে যায় কাঁকনমালা আর কাঞ্চনমালার কথাও। সে গল্পে কে রানি আর কে দাসী, তার মীমাংসা হয়েছিল পিঠে বানানোর ক্ষেত্রে দুজনের মুনশিয়ানা দেখে। যেখানে দাসী বানিয়েছিল আস্কে পিঠে, ঘাস্কে পিঠে, আর রানি বানিয়েছিলেন সরুচাকলি, চন্দ্রপুলি, আরও কত কী! এই যে ব্যক্তির সাপেক্ষে তাদের নিজস্ব রুচি ঢুকে পড়ল রান্নার ক্ষেত্রেও, এই বিষয়টি পিঠে তৈরির সময়েও গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করেন সামরান হুদা। রন্ধননৈপুণ্যে নিজস্বতাকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি চর্চা করেন খাদ্যসংস্কৃতিরও। তাঁর মতে, আলপনার মতো, হাতের কাজের মতো, পিঠেও আসলে বাংলার ঘরের মেয়েদের গোপন নিজস্ব শিল্পবোধের প্রকাশ।
আরও শুনুন: SPECIAL PODCAST: প্রতিভা সরকারের গল্প ‘সহোদরা’
আসলে যেসব স্মৃতি বুনে বুনে মানুষের নস্টালজিয়া বাসা বাঁধে, খাবারদাবার তার একটা বড় অংশ। আর বাঙালির ক্ষেত্রে সেই খাদ্যসংস্কৃতির অনেকখানিই জুড়ে রয়েছে মিষ্টি। মঙ্গলকাব্যের দিকে তাকাই যদি, সেখানে কখনও মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত ক্ষীর-সহ দুধের পঞ্চ পিঠা তৈরির গল্প শোনাচ্ছেন, তো কখনও বিপ্রদাস বলছেন ছয় বউমাকে নিয়ে চাঁদ সদাগরের পত্নী সনকার প্রচুর পরিমাণে পিঠে ও পায়েস রান্নার গল্পকাহিনি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সাধভক্ষণের সময় মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছে যে মেয়ে, তারও দাবি কিনা, ‘খাব নারিকেল তিলের পিঠা’। কিংবা অন্নদামঙ্গলে ব্রতপুজোর সময় ব্রাহ্মণদের শেষপাতে দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সেই পিঠে পুলি। আবার নীলাচলে মহাপ্রভুকে যা যা খাবার সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যেও রয়েছে রকমারি পিঠের সমাহার। এখান থেকে আরও একটা কথাও কিন্তু স্পষ্ট। উৎসব অনুষ্ঠান কি কোনও বিশেষ উপলক্ষ্যেই রান্না হচ্ছে পিঠে। কে না জানে, যা কিছু দুর্লভ, তারই দাম বাড়ে। পিঠেপুলি সারাবছর মেলে না বলেই বাঙালির জীবনে, বাঙালির স্মৃতিতে তার টান এত অমোঘ। আজকের দিনে চাষের জমি থাক বা না থাক, এই লোকউৎসবের ধারাটি কিন্তু একইভাবে বয়ে চলেছে। ব্রহ্মপুরাণ যতই ৫১ পীঠকে পিঠে-র উৎস বলে দাবি করুক, কিংবা মহাভারতেও যতই পিঠের উল্লেখ থাকুক না কেন, পিঠে পার্বণ, থুড়ি, পৌষ পার্বণের কপিরাইট কিন্তু একমাত্র বাঙালিরই।