ছেলেবেলাতেই হারিয়ে যায় দেশ। আবার ছেলেবেলাতেই নতুন দেশে নতুন ঘর গড়া। এদিকের শিকড় উপড়ে ওদিকে বসানো, তবু প্রাণরস ছেনে নিয়ে গাছের মতোই বেঁচে থাকার গল্প বোনে জীবন। ছেলেবেলার সে গল্প-জীবন কেমন ছিল মনোজ মিত্রের?
ছোটবেলাতেই হারিয়ে গিয়েছিল দেশ। হারিয়ে গিয়েছিল ছেলেবেলার চেনা ভিটেমাটি। পরিবারগুলো ছেঁড়া কুটিকুটি কাগজের মতো তখন উড়ছিল এ দেশে ও দেশে। সেই ছেঁড়াখোঁড়া সময়ে গল্পের সুতো দিয়েই বুঝি নিজের মনটাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন মনোজ মিত্র। তাই গল্প আঁকড়ে ধরেই বেড়ে ওঠা তাঁর। নিজের মনের মধ্যে হাজারও গল্প কিংবা না-গল্পের জল্পনা। আর সেসব বুনে বুনে গল্প লেখার শখ।
তখন বছর বারো বয়স। লুকিয়েচুরিয়ে চলছে লেখালিখির চর্চা। উদ্বাস্তু হয়ে আসা পরিবারে এসব শখ দেখলে সবাই বলবে ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’! তাই নিতে হল ছলনার আশ্রয়। খুব ভোরে উঠে সামনে বই খুলে রেখে তার আড়ালেই চলত হাতমকশো। বাড়ির সকলেই ছেলের মনোযোগ দেখে সন্তুষ্ট, কেবল মেজোকাকার চাহনি থেকে অবিশ্বাসের ভাঁজ মিলিয়ে যেত না কিছুতেই। আর সেই সন্দেহটাই একদিন সত্যি হয়ে জানাজানি হয়ে গেল। স্কুলের গণ্ডি ছাড়াতে তখন আর বছর দুয়েক বাকি। মাস্টারমশায়দের উৎসাহে উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারা প্রতি মাসে বের করে একটি হাতে লেখা পত্রিকা, তার নাম ‘কল্পনা’। সেখানেই প্রকাশ পেল কিশোর মনোজের গল্প- ‘বাঁশির সুর’। হেডমাস্টারমশাই থেকে পড়শি দিদি, সকলের প্রশংসা কুড়িয়ে লেখকও খুশি। কিন্তু বাবার কাছে জানাজানি হয়ে যেতেই বাধল গোল। গল্পের শীর্ষচিত্রে যে ভিজে কাপড়ে জানলার গরাদে বুক চেপে দাঁড়িয়ে একটি বউ। এহেন ‘বড়’দের ছবি দেখেই পত্রিকা ছুড়ে ফেলে বাবার কড়া গলায় ঘোষণা- ‘এখানে ওর লেখাপড়া হবে না। কালই ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব।’
বাবা যতই বলুন গল্প-টল্প লিখে কিছু হবে না, কিংবা উপনিষদ-জাতক পড়ার সুপরামর্শ দিন, ছেলের মন থেকে গল্পের ভূত নামাবে কে! পরদিন বাবাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ফেরার পথেই মাথায় এসে গেল দ্বিতীয় গল্পের বীজ। কিন্তু তারপর কী হল? ‘গল্পনা’ বইয়ে মনোজ মিত্রের টিপ্পনী- “নিরীহ ওই কৌতুককাহিনিটা লিখে আমি যে ভরদুপুরে জ্যান্ত ভূতের ঢিল খাব তা কি তখন জানতাম?” সীমান্তের ওপারে ফেলে আসা গ্রামের এক পুরোহিত আর তাঁর কিছুতেই ক্লাসে পাশ করতে না-পারা ছেলের গল্প শুনে এপারের স্কুলের এক ফেল-করা পড়ুয়ার মনে হল, এ বুঝি তাকেই কটাক্ষ করা! অতএব অন্ধকার বাঁশঝাড়ে আধলা ইট নিয়ে একদিন দেখা দিল সে!
ফেলে আসা দেশ আর নতুন পাওয়া বসত ঘিরে এমনই নানা মুখের ভিড়। নানা রকমের চরিত্র। আর উৎসুক দুচোখে সেইসব চরিত্রকে দেখেছেন কিশোর মনোজ। সেই দেখা না-দেখায় মেশা তাঁর গোটা জীবন। যে মনোজ মিত্র বড়বেলায় পৌঁছে নাটক লিখবেন, নানা চরিত্রের রং ফুটিয়ে তুলবেন লেখায় কিংবা অভিনয়ে, সেই সফরের শুরুয়াত হয়তো এই দেখার মধ্যে দিয়েই।