দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, মলয় চট্টোপাধ্যায়-এর গল্প শিশি রহস্য। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্রামে গৌরাঙ্গ চক্রবর্তীকে আধপাগলা গোরা ডাক্তার নামে সবাই চেনে। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ভিজিট মাত্র দশ টাকা। স্কুল থেকে রিটায়ার্ড করার পর বাবার পড়ে থাকা পুরোনো হোমিওপ্যাথির বইগুলিই তার সম্বল। টেবিলের উপর রাখা কালো রঙের কয়েকটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি আর গোটা দুই বই। সারাদিনে দু-চারটে হতদরিদ্র রুগি আসে বটে, তবে অনেকেই পয়সা না দিয়েই চলে যায়। ভাগ্যিস স্কুলের পেনশনের টাকাটুকু ছিল, না হলে ডাক্তারের গোটা পরিবারকে পথে বসতে হত।
আজ সকালে আরশি টেবিলের উপর চায়ের কাপটা রাখতেই গোরা ডাক্তার খুব আনন্দিত হয়ে মেয়েকে বলল, একটা দারুণ খবর আছে। অনেক চেষ্টায় আজ মনে হচ্ছে ওষুধটা তৈরি করতে সফল হলাম।
আরশি বলল, কী ওষুধ বাবা?
– এই ওষুধ দু-ফোঁটা মুখে পড়লেই মিথ্যুকরা সত্যি কথা বলতে শুরু করবে। এবারে আর কেউ সত্যি কথাগুলো পেটে লুকিয়ে রেখে মিথ্যার অভিনয় করতে পারবে না।
আরশি ঘরের ভিতরে এসে চুপিচুপি মাকে সুখবরটা জানাতেই, শান্তিলতা রেগেমেগে আগুন।
শান্তিলতা আরশিকে বলল, আবার তোর বাবার পাগলামিটা শুরু হল। এত বড় হলি, কলেজে পড়ছিস, এখনও তোর বাবাকে বুঝতে পারলি না। তোর বাবাকে বল গে আগে পাগলামির একটা ওষুধ আবিষ্কার করে নিজেকে দুফোঁটা খেতে, তারপর লোকের কথা চিন্তা করবে।
আরশি মনটা খারাপ করে বলল, তুমি সবসময় বাবাকে ছোটো করার চেষ্টা করো। এটা ঠিক নয়। বাবারও তো একটা সম্মান আছে।
গোরা ডাক্তার দমবার পাত্র নয়। তার একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু আরশির সাথে আলোচনা করে আবিষ্কৃত এই ওষুধ কার ওপর প্রথম প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিল। দুদিন পেরিয়ে গেল। টেবিলের উপর কালো শিশিতে রাখা আবিষ্কৃত ওষুধটি পড়ে আছে, কিন্তু প্রয়োগ করার রুগি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আজ সকালে আরশির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাবাকে বলল, তোমার হাতের কাছেই তো রুগি। ওদিকে তাকিয়ে দেখো হারু ঘোষ দরজায় বসে আছে।
ডাক্তারের দুধওয়ালা হারু ঘোষকে পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। হারুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঘরে এনে দুফোঁটা ওষুধ খাইয়ে দিল।
ওষুধ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারুর মুখ তো কিশমিশের মতো কুচকে গেল। হারু বলল, কেমন যেন ঝাঁঝালো গন্ধ, খুব চেনা চেনা লাগছে।
ডাক্তার বলল, হোমিওপ্যাথি ওষুধ বলে কথা, গন্ধ একটু তো থাকবেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধের গুণ প্রকাশ পেল। হারুর পেট থেকে সত্যি কথা গলগল করে বেরোতে শুরু করল।
হারু নিজের থেকেই বলতে শুরু করল, বিশ্বাস করুন, দুধে জল অল্প মেশাই। কক্ষনও বাজে জল মেশাই না। আর একটা কথা, কোনও কোনও দিন দুধ কম হলে ভালো কোম্পানির পাউডার দুধ মাঝেমধ্যে মেশাই।
ডাক্তার ও আরশি আনন্দে আত্মহারা। হাতেনাতে ওষুধের গুণ দেখে অবাক। হারুর সব সত্যি কথা আজ পেট থেকে বেরোতে শুরু করেছে। ডাক্তার ও আরশি হেসে হেসে অস্থির। হারু কিছুই বুঝতে পারল না।
এদিকে শান্তিলতার এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পুরোহিত আসার সময় হয়ে গেছে। আজ ঘরে শান্তির জন্য পুজোর আয়োজন করতে ব্যস্ত। শান্তিলতা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে হারুকে জিজ্ঞেস করল, পঞ্চগব্যের সব জিনিস ঠিকমতো গতকাল দিয়ে গেছিস?
হারু বলল, হ্যাঁ মা। পঞ্চগব্যের দুধ, দই, ঘি, গোময় এখন দিলাম আর গতকাল আপনার দেওয়া শিশিতে করে গোমূত্র ওই টেবিলে বিকেলে রেখে গেছি।
যাই হোক, হারু বেচাকেনা করে সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরে গেছে। পুজোর কাজও ভালোভাবে শেষ হয়েছে। দুপুরে নিরামিষ খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই ভাতঘুমে যখন ব্যস্ত, তখন ডাক্তারের মাথায় অন্য মতলব ঘুরঘুর করছে। ডাক্তার আরশির ঘরে চুপিচুপি ঢুকে দুফোঁটা ওষুধ আরশির ঠোঁটের ফাঁকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
বিশ্রী ওষুধের গন্ধে আরশির ঘুম গেছে চটকে। সুজয়কে নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখাটা শেষ হল না। আরশি বুঝতে পেরেছে এটা বাবার কাজ। স্বপ্নের ঘোর তখনও কাটেনি। একটা উপস্থিত বুদ্ধি আরশির মাথায় খেলে গেল। আরশি ভাবল সুজয়ের ব্যাপারে যে কথাগুলো সে এতদিন মা বাবাকে ভয়ে বলতে পারেনি, আজ এই সুযোগে সব বলে দিলে তো ভালোই হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আরশি মুখটা ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল মা বাবা দুজনেই দাঁড়িয়ে।
আরশি বলল, তোমরা দুজনেই রয়েছ, ভালোই হল। একটা সত্যি কথা বলছি। আমি কলেজের বন্ধু সুজয়কে ভালোবাসি। ওকেই আমি বিয়ে করব। ও আমাদের জাতের নয় ঠিকই কিন্তু শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের ছেলে। এখন জাতপাত নিয়ে কেউ আর এত ভাবে না। তোমরা অমত কোরো না। এক নিমেষে কথাগুলো বলে আরশি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
ডাক্তার বলল, বা! বা! এ তো খুশির খবর। ওষুধ দারুণ কাজ করছে। আরশিও আজ সব সত্যি কথা বলেছে, একটাও মিথ্যা না। তার মানে আমার ওষুধ সব দিক দিয়ে ভালো কাজ করছে।
শান্তিলতা বলল, রাখো তোমার ওষুধের কথা। সব ঠিক আছে, কিন্তু একটা কথা মিলছে না।
আরশি বলল, কী মিলছে না মা? যা বলবে পরিষ্কার করে বলো।
– কী আর বলব! সব উলটোপালটা হয়ে গেল।
আরশি বলল, বুঝতে পারছি। সুজয় অন্য জাতের ছেলে বলে বলছ তো?
শান্তিলতা বলল, আরে বাবা ওসব বলছি না। জাতপাত, ভেদাভেদ আমি মানি না। ধুমধাম করে ওখানেই তোর বিয়ে হবে। আমি ভাবছি তোর বাবাকে নিয়ে। শেষে কিনা সবাইকে ওষুধের নামে গোমূত্র খাইয়ে ছাড়ল।
ডাক্তার বলল, তার মানে?
– মানেটা হচ্ছে হারু পঞ্চগব্যের জন্য আনা গোমূত্রের কালো শিশিটা তোমার টেবিলে রেখে গেছিল। সেটাই তুমি ওষুধ ভেবে খাইয়ে বেড়াচ্ছ আর তোমার আবিষ্কৃত ওষুধের কালো শিশি আমার ঠাকুরঘরে পড়ে আছে।
আরশি তো হেসে অস্থির।
শান্তিলতা বলল, যাক ভালোই হয়েছে। ওই গোমূত্রের গুণে আমার মেয়েটা তো সত্যি কথা বলেছে। আমি খুশি।
ডাক্তার আরশির মাথায় হাত রেখে বলল, আমিও খুশি। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: