দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, মৌসুমী দেবঘোষ-এর গল্প বৃক্ষরোপণ। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাছের ছায়ায় বসে ঢুলছিল বৃদ্ধ ব্রজ বাউরি। দূরে ওর ভ্যানটা গাছের ছায়ায় রাখা। মাথার উপর খাঁ খাঁ করছে জৈষ্ঠের আকাশ, কি রোদ্দুর আজ! মুখচোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে এক্কেরে। গায়ের ঘাম শুকাতেই চায় না,কাঁধের গামছাটা দিয়েই হাওয়া করে নিজেকে। মাটি থেকে যা গরম ভাপ উঠছে…মনে হয় ওবেলা ঝড় উঠবে। কানে গুঁজে রাখা আধপোড়া বিড়িটা ধরিয়ে একটা টান দেয়।কে জানে আজ কখন ছাড়া পাবে!কোন সকালে এসেছে চাট্টি পান্তা ভাত আর আলুসেদ্ধ মুখে দিয়ে,এতক্ষণে সব হজম হয়ে পিত্তি পড়ে গেছে। কিন্তু কাজ শেষ না করে ওর তো ফিরবার জো নেই, নার্সারি মালিকের কড়া হুকুম আছে- ঠিকঠাক ভাবে সব ফেরত নিয়ে যাবার ।নইলে একটা ফুটো কড়িও মিলবে না। একবার শুধু দেখে নেয় আর কত দেরি এসব ভ্যান্তাড়া শেষ হতে।বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে আবার দুহাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে ঝিমাতে থাকে। আজ এখানে কি একটা হবে,গাছ লাগানোর উৎসব।এরা বলে ‘বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান’ না কি যেন। ব্রজ বাউরির সারাটা জীবন তো এসব নিয়েই কেটে গেল …গাছপালা–মাটি- সার, কিন্ত তা নিয়েও যে আস্ত একটা দিন হয,এতো ঘটা হয় বাপকালেও জানতো না।
এখানে সকাল থেকে অনুষ্ঠানেরই প্রস্তুতি চলছে।উদোক্তাদের ছুটোছুটি,মাইকের আওয়াজ , মানুষের চেল্লামেল্লিতে কান পাতা দায়! কত মান্যি গন্যি লোকজন এসেছে,বিডিও সাহেব এসেছেন ,পঞ্চায়েত প্রধান আছেন, পার্টির ছোট-বড়-মেজ সব নেতাই আছে।বাকি শুধু এমএলেবাবু,তিনি এলেই নাকি মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। এতক্ষণ মাইকে জোরে জোরে হিন্দি গানই বাজছিল, কানে তালা লেগে যাচ্ছিল ব্রজর। তাই তো এতদূরে এসে বসেছে।এখন অবশ্য অন্য গান বাজছে। একটা সুন্দর পারা ছেলে মাইক হাতে মঞ্চে ঘুরে ঘুরে কিসব যেন আগডুম-বাগডুম বলে চলেছে।একটু পরেই কতকগুলো অল্পবয়সী ছুকরি হারমোনি বাজিয়ে গান গাইল। ওর লাতিনটার মতন একদল ছোট ছোট মেয়ে কি
সুন্দর মাথায় লালহলুদ ফুল গুঁজে নেচে গেল! দেখতে কিন্তু বেশ লাগছিল ওর। সবাই বারবার রাস্তার দিকেই দেখছে এম এলের গাড়ি আসছে কিনা , ব্রজও। এইসবের মধ্যেই চোখটা কখন যে লেগে গেছিল বুঝতেই পারেনি!
হুড়োহুড়ি শুনে ওর ঢুলুনি কেটে যায়, বোঝে এম এলেবাবু এসে পড়েছেন । যাক বাবা বাঁচা গেল। এম এলেবাবু গাড়ি থেকে নামতেই চন্দনের ফোঁটা,ফুলের তোড়া আরো কত কি দিয়ে ঘটা করে তাঁকে বরণ করা হলো।একটু পরে শুরু হল গাছ লাগানো।শাঁখ বাজল, উলুধ্বনি হল, ফটাফট ছবি উঠল, বক্তিমে হল। এম এলেবাবু মাইক হাতে কত কি যেন বললেন..’গাছ লাগানো কত দরকার, গাছ না লাগালে বাতাস নাকি বিষ হয়ে যাবে ,মনিষ্যি বাঁচবে না…!’
আরও ক-ত কথা! সব কথা ব্রজর মাথায় ঠিক ঢুকলোও না।এম এলেবাবুর বক্তৃতা শেষ হতে সবাই হততালি দিচ্ছিল। এত মানুষের হততালির চটপট শব্দে গাছের পাখিগুলো ভয়ে পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উড়ে গেল। ব্রজ বাউরি মুক্ষুসুক্ষু মানুষ, জীবনে কখনও নেকাপড়া করার সুযোগই হয়নি। কিন্ত কয়েকটা বেয়াড়া প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে কেবলি কুটকুট করতে থাকে। গাছ সত্যিই যদি এত দরকারি তবে কদিন আগেই বিডিও অফিসের যাবার রাস্তা তৈরি করতে অত গুলো গাছ কাটলো কেনে? প্রধান তো নিজেই দাঁড়িয়েই সে সব গাছ কাটালেন। কত পুরানো সব গাছ,ব্রজর বাপঠাকুর্দারও আগের সময়কার! এক একটা গাছের বেড় এতটাই বড় যে চারটে জোয়ান ছোকরা হাতে হাত ধরেও ধরতে লারবে। তার বদলে এই লিকলিকে গাছ কটা লাগিয়ে বাতাসের বিষ মারা যাবে? এর জন্যি এতো ঘটাপটা…কে জানে বাপু!
এম এলেবাবু অবশ্য বেশিক্ষণ থাকলেন না।তাঁকে আজ কত জায়গায় যেতে হবে, কত গাছ লাগাতে হবে , দাঁড়াবার সময় কই! একটু পরেই তাঁর গাড়ি হুটার বাজিয়ে বেরিয়ে যেতেই , একে একে অন্যদের গাড়িগুলোও বেরিয়ে যেতে লাগল । মঞ্চের একপাশে টিফিনের প্যাকেট বিলি করা হচ্ছিল,সেখানে তখন কি হুটোপাটি…সবাই আগে পেতে চায়। ব্রজ বসে বসে মজা দেখছিল।ওর যদিও বেশ খিদে পেয়েছিল,একটা প্যাকেট পেলে ভালই হতো।তবুও উঠতে ইচ্ছা করছিল না। কে যেন একটা প্যাকেট দিয়ে গেল ওকে। জায়গাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল।ইতস্ততঃ পড়ে থাকল খালি চায়ের কাপ, ফুলের মালা, রঙিন কাগজ, রাঙতা মোড়া ফুলের তোড়া,খাবারের খালি প্যাকেট।হাওয়ায় এদিকওদিক উড়ে বেড়াতে লাগলো খালি প্যাকেটগুলো ফরফর করে।
এতক্ষণ কয়েকটা লোক ওর মতই বসেছিল একপাশে , ডেকরেটরের লোক । মুহুর্তের মধ্যে ওরা কাজে লেগে পড়ল।ওদের মঞ্চ খোলা হয়ে গেল, বাঁশ-কাপড়, চেয়ারটেবিল, মাইকসেট বাঁধাছাঁদা করে ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে ওকেও ডেকে গেল-‘ কই গো খুড়ো , ঘুমুলে নাকি ? বসে রইলে যে বড়ো , সন্ধ্যা হয়ে এলো তো । যাবেনি নাকি?’
ব্রজর যেন তাড়াই নেই এমন ভাবখানা। আড়মোড়া ভেঙে বলল – ‘তুরা এগা কেনে, আমি এই যাই বাপ।’
সবাই চলে গেলে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ব্রজ বাউরি। এবারই তো ওর আসল কাজ শুরু।সন্ধ্যা হয়ে আসছে, শুনশান চারধার। কয়েকটা কাঠবেড়ালি শুধু গাছের ডালে ছুটোছুটি করছে,একদল ঘরমুখো পাখি মাথার উপর দিয়ে কিচিরমিচির করে উড়ে যাচ্ছে।
নিশ্চিন্ত হতে ব্রজ আর একটু অপেক্ষা করল, বলা তো যায় না , কে কোথা থেকে ছবি তুলে লিয়ে ছড়িয়ে দিলেই সব্বোনাশ!লোক জানাজানি হলে আর রক্ষা নেই ! এখন সব্বার হাতে হাতে ফটো –তোলা ফোন , ফটাক্ করে ছবি খিঁচলেই কম্ম সারা ! মালিক বারবার বলে দিয়েছে, সাবধানে কাজ করতে, কেউ যেন টেরটি না পায়!
আর একটু অপেক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে ব্রজ কাজে লেগে পড়ে , দ্রুত সদ্য লাগানো গাছগুলো গর্ত থেকে তুলে ওর ভ্যানে তুলে নেয়। শূন্য স্থানে বসিয়ে দেয় আগে থেকে কেটে রাখা শুকনো গাছের ডাল । এমন আরও গোটা কতক জায়গা থেকে গাছ তুলে নার্সারিতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে ওকে। প্রতিবছর তাই করে। বাবুলোক ওত কে খোঁজ রাখে ? গাছ লাগানো হয়ে গেলে, ছবি তোলা হয়ে গেলেই তাঁদের কম্ম সারা। কাগজে ছবি বেরাবে, টিভিতে দেখাবে , কে আর খোঁজ রাখে লাগানো গাছগুলোর! অর্ধেক এমনিই মরে যায় অযত্নে, বাকি গুলো গরু ছাগলে খেয়ে ফেলে। যেখানে সেখানে যেকোনো গাছ লাগালেই বাঁচবে কেনে ? এই রুখাশুখা মাটিতে যত্ন ছাড়া গাছ বাঁচে কখনো ? কত যত্ন করলে তবেনা প্রাণ বাঁচে!
পার্টির লোকেরা ফোন করে ওর মালিককে বলে দেয় অমুক দিন গাছ পাঠিয়ে দিতে, পরে নাকি টাকা দেবে। সে পরে আর হয়না কোনদিনই । ঘটা করে কিন্তু গাছ লাগানোর মোচ্ছব করা চাই প্রতিবছর। গাছ না পাঠিয়ে উপায় বা কি , ব্যাবসা করতে পারবে? জলে বাস করে কেউ কুমিরের সাথে লড়াই করে নাকি? তাই ওর মালিকই বুদ্ধি করে এই ব্যবস্থা করেছে। ব্রজ বহুদিন কাজ করছে এই নার্সারিতে,পুরোনো লোক..খুব বিশ্বাসী।প্রতিবছর গাছ আনা ,আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ভার তাই ওর উপরেই থাকে। একাজে আর কাউকে ভরসা করে না মালিক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঈশান কোনে মেঘ আঁধার করে আসছে,ঝড়ে উঠলো বলে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাছগুলো নার্সারিতে পৌঁছে দিলেই ওর ছুটি, তারসাথে মিলবে উপরি কড়কড়ে একশোটা টাকা!
কাজ গুছিয়ে দ্রুত ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দেয় ব্রজ বাউরি। এবছরের মতন বৃক্ষরোপণ মোচ্ছব শেষ, আসছে বছর আবার হবে!