দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, সুতীর্থ দাশ-এর গল্প ব্রেকিং নিউজ। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস, সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভদীপ রায়
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
সকাল থেকে প্রায় দশবার ঘর আর ব্যালকনি করে ফেলেছেন বিজনবাবু। চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এবার দেখছি কাগজ বন্ধই করে দিতে হবে’, তারপর স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন, ‘জয়ন্তদের বাড়িতে কে কাগজ দেয় গো? এই বলরামের কাছ থেকে কাগজ নেওয়া যাবে না। এমনিতেই রোজ কাগজ সবশেষে আমাদের দেয়, তার ওপরে মাঝেমধ্যেই কামাই।’
‘কোথায় কামাই?’, স্ত্রী সাবিত্রী বোঝাবার চেষ্টা করলেন, ‘গত সপ্তাহে তো কী সব ভেন্ডারদের গোলমালে কাগজ দিতে পারেনি।’
‘আর তার আগে– গত মাসে?’ গজগজ করতে করতে বললেন, ‘তিন দিন কাগজ দেয়নি, ভুলে গেলে?’
‘সে তো ও অসুস্থ ছিল। কী করবে? তারপর থেকে তো ব্যবস্থা করেছে। সেরকম এমার্জেন্সি হলে বলরামের ছোট ছেলেটা স্কুল যাবার আগে কাগজ দিয়ে যাচ্ছে তো।’
‘যাচ্ছে? তা আজ কোথায় সে?’ বিরক্ত স্বরে বললেন বিজনবাবু, ‘ঘড়ি দেখেছ ? নটা বাজে!’
‘আচ্ছা একটা কথা বলো তো, পেপার ছাড়া কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? তোমাকে তো বলি সন্ধ্যাবেলা টিভিতে নিউজ দেখে নাও– সেটা তো করো না’, সাবিত্রীও বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
‘ছ্যাঃ, টিভিতে নিউজ কোনও ভদ্রলোকে দেখে নাকি? ওগুলো খবর নয়– চানাচুর পরিবেশন করে। একটা খবর নিয়ে যখন শুরু করে, সেটা নিয়ে শুধু কচলায়– এটাকে তুমি নিউজ বলো? দেখছ না পরশু থেকে ওই এক রেল দুর্ঘটনা নিয়ে সেই যে শুরু করেছে, সে তো থামার নামই নিচ্ছে না।’
বিজনবাবুর দিন শুরু হয় এক কাপ চা আর খবরের কাগজ দিয়ে। বাড়িতে একটা অলিখিত নিয়ম হল– কাগজ এসে পৌঁছলে বিজনবাবুর চায়ের জল চাপাতে হবে। চা খেতে খেতে কাগজ পড়বেন তিনি। কাগজ না আসা পর্যন্ত তিনি দিনের প্রথম চায়ে চুমুক দেন না। আজ তাই মেজাজ একদম সপ্তমে ছিল। নটা বেজে গিয়েছে অথচ হাতে না কাগজ, না চায়ের কাপ। কার মাথা ঠিক থাকে এই অবস্থায়!
ছেলে লন্ডনে থাকে। গতবার ছুটিতে বাড়ি এসে মা আর বাবা – দুজনকেই দুটো দামি অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে দিয়ে গিয়েছে। সাবিত্রীর তাতে খুব উপকার হয়েছে, দিনে প্রায় বহুবার নাতির সাথে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিয়োতে কথা বলছেন আবার কখনও মেসেজ পাঠাচ্ছেন। গতবারে এসে নাতি ঠাকুমার জন্য একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্টও খুলে দিয়েছে, তাতে সাবিত্রী আরও মজা পেয়েছেন । গোটা বিশ্ব যেন তাঁর সম্মুখে কেউ মেলে ধরেছে ! ইউটিউবে গান শুনছেন, ছোট বোনকে দুর্গাপুরে ভিডিয়ো কল করছেন, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট করছেন বন্ধুদের সাথে– সারাদিন যে কীভাবে সময় কেটে যায় নিজেই টের পান না।
ঠিক একইরকমের ফোন বিজনবাবুর কাছেও, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র কল করতে আর কল রিসিভ করতে ব্যবহার করেন উনি। এর বেশি কিছু না। তাঁর বন্ধু আর প্রাক্তন সহকর্মী অজয়বাবু একদিন বললেন, ‘বিজন, তুই হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাপটা ডাউনলোড করে নে, তাহলে আমাদের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করে নেব।’
‘ওই সব ফালতু জিনিসে আমার ইন্টারেস্ট নেই’, সাফ জানিয়ে দিলেন বিজন বাবু, ‘তোদের অফুরন্ত সময়, তোরা ওসব নিয়ে থাক।’
‘তা তুইই বা ব্যস্ত কীসে? কী এমন রাজকার্য করিস এই রিটায়ারের পর?’ অজয়বাবু পালটা জিজ্ঞাসা করেন।
‘রাজকার্য মানে আমার পড়াশোনার মধ্যে দিয়েই সময় কেটে যায়। কাগজ আছে, পত্রিকা আছে– গতবার বইমেলায় কেনা বইগুলো তো আর তোদের মতন শোকেসে সাজাবার জন্য কিনিনি, ওগুলো পড়ে শেষ করতে হয়।’
****
খবরের কাগজের অন্য ব্যবস্থা করতেই হল । সাতদিন হয়ে গেল বলরামের পাত্তা নেই। সাবিত্রী অবশেষে পাশের ফ্ল্যাটের জয়ন্তকে দিয়ে ওদের কাগজওয়ালার সাথে কথা বলে নিলেন। অল্পবয়েসি ছেলে, কাগজটাও খুব সকাল সকাল দেয়। বিজনবাবুর বেশ সুবিধে হয়েছে। মন খুব খুশি। ঘড়ির কাঁটা ধরে কাগজ আসে– ভোর ছটা থেকে ছটা দশের মধ্যে কাগজ এসে হাজির হয়ে। তাতে যে সুবিধেটা হয়েছে, সেটা হল বিজনবাবু আজকাল বাজারটাও তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে পারছেন।
সেদিন রবিবার ছিল। বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিচে নেমেছেন, আর ঠিক তখনই নজরে পড়ল, ফ্ল্যাটের গেট খুলে বলরামের ছেলে ঢুকছে। হাতে সেদিনের কাগজটা। বিজনবাবুকে দেখে থেমে গিয়ে বলল, ‘দাদু তোমার কাগজটা…’
ছেলেটাকে দেখে মাথাটা গরম হয়ে গেল। ‘কী রে তোরা কী ভেবেছিস কী?’ বিজনবাবু বলতে শুরু করলেন, ‘যা ইচ্ছে তাই করবি? যখন ইচ্ছে হবে কাগজ দিবি, যখন ইচ্ছে হবে দিবি না– শোন, তোদের আর কাগজ দিতে হবে না। অন্য লোক ঠিক করেছি।’
বলরামের ছেলে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। বিজনবাবু আবার শুরু করলেন, ‘বলরাম কোথায়? ও এল না কেন?’
ছেলেটা মুখ তুলে বলল, ‘বাবা নেই।’
‘নেই মানে?’ একটু চমকালেন বিজনবাবু, ‘কোথায় গিয়েছে?’
‘বাবা মা দুজনেই নেই। গত শনিবারের বালেশ্বরের রেল অ্যাক্সিডেন্টে দুজনেই…’
‘বলিস কী রে?’ আঁতকে উঠলেন বিজনবাবু, ‘হঠাৎ… কোথায় যাচ্ছিল?’
‘কটকে দিদিমা থাকে। খুব অসুস্থ। একলা থাকে দিদিমা। দেখাশোনার কেউ নেই বলে বাবা তাই মাকে কটকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল আর ব্যস… সব শেষ।’
‘আমাদের জানাবি তো’, আসলে কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না বিজনবাবু।
‘জানাব আর কী। খবর পেয়ে ছুটলাম। জানো দাদু, ওদের বগিটায় কেউ বাঁচেনি। আমরা বডিও পাইনি। আমাদের যাবার আগে প্রচুর বডি সরিয়ে ফেলেছিল পুলিশ। তবে আমাদের কথা অনেকে জেনেছে আমাকে টিভিতে দেখে। কলকাতার বাংলা চ্যানেলে আমাকে দেখিয়েছে। ওরা অনেক প্রশ্ন করেছিল। অনেকেই সেটা দেখেছে।’
কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর নিজের অজান্তেই ছেলেটির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে হাঁটা দিলেন। একবার ঘুরে ছেলেটিকে বললেন, ‘শোন বাবা, কাল থেকে বাংলা কাগজটা আর দিস না। তুই বরঞ্চ একটা ইংরেজি কাগজ দিয়ে যাস।’
বাজারের থলেটাতে কাগজটা ফেলে নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বাজারের উদ্দেশে হাঁটা দিলেন, ‘লোকটা খবর বিলি করতে করতে নিজেই খবর হয়ে গেল?’
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: