শরৎকাল জুড়ে পুজোর গল্প। গল্পের এই মরশুমে শুনুন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র নিবেদনে নতুন গল্প। আজকের গল্প, কিশোর ঘোষ-এর ‘গরু খোঁজা‘। পড়ে শোনাচ্ছেন, পড়ে শোনাচ্ছেন, শঙ্খ বিশ্বাস, চৈতালী বক্সী। অলংকরণে অর্ঘ্য চৌধুরী।
শুনুন গল্প: ‘গরু খোঁজা‘।
মন্টু আমাকে গরু-খোঁজা খুঁজছে। নকল গরু-খোঁজা না, আসল ব্যাপার। আমি জানলা দিয়ে দেখেছি, দলবল নিয়ে আগ্রাসী মন্টু আমার বাড়ির সামনের দিকের গেট খুলে, উঠোন ডিঙিয়ে বারান্দা মুখো।
কপালে গেরুয়া তিলক, মুখে স্লোগান- ‘জয় গোমাতা’, ‘ভারতমাতা কি জয়’।
আরও একটা কী যেন ‘জয়’! ঠিক ধরতে পারলাম না। ধরার মতো অবস্থায় নেই। মন্টুকে দেখেই বসার ঘরের সোফা ছেড়ে তড়িঘড়ি বাথরুম ঢুকে পড়েছি আমি।
ঋতু, মানে আমার বউটাকে দেখতেই যা ভাল, ঘটে বুদ্ধি নেই। রান্নাঘরে থেকে চেঁচাচ্ছে, ‘কী গো, আবার বাথরুমে ঢুকলে? একটু আগেই তো গেছিলে! আবার পেট খারাপ? আমার রাধা আলুর ঝোল খেলেও পেট খারাপ হয় তোমার! পাশের বাড়ির টুম্পা বউদি সেদিন চিলি চিকেন দিয়ে গেল, দিব্যি হজম করলে! লেখকরা দুশ্চরিত্র হয় জানতাম, তাই বলে এতখানি। আমার কপাল পুড়ল গো!’
টানা বক্তৃতায় হাঁপিয়ে থামল ঋতু। তাছাড়া ‘তরাং তরাং’ কলিংবেল বাজল। দরজা খোলার শব্দ। মন্টুর গদগদ গলা—‘কেমন আছেন বৌদি। দাদা কোথায়?’
ঋতুর রানি মুখার্জি মার্কা খসখসে কণ্ঠস্বর দুম করে কিয়ারা আডবানীর মতো মোলায়েম হয়ে গেল—‘মন্টু যে! কেমন আছ তোমরা সব? এসো এসো। তোমাদের দাদা বাথরুমে। পেটটা ভাল নেই তো। চা খাবে?’
মন্টুর ভয়ে বাথরুমে সেঁধিয়ে ছিলাম বটে, কিন্তু এখন রাগে চিড়বিড় করছে শরীর। লাফাঙ্গাটাকে এত আদর দেখানোর কী আছে! এই জিনিসটা আগেও দেখেছি ঋতুর মধ্যে। মন্টুর দলবল পুজো, ফাংশান, এটাসেটায় চাঁদা চাইতে এলে আমার বউটি দরাজ হস্ত! এদিকে আমি মাসে পাঁচটার জায়গায় সাতটা বই কিনলে খিঁচ-খিঁচ—‘আবার বই! ঘরটাকে নরক বানিয়েছ! কোথায় রাখবে শুনি? চেলা-বিছে-ওরাংওটাং-ইয়াতি… কী নেই তোমার ওই লেখার ঘরে! পরিষ্কার করতে আমার প্রাণ যায়। তাছাড়া খরচের দিকটাও তো একবার ভাববে!’
মন্টুর ব্যাপারে ঋতুর ‘জলে গল’ ব্যাপারটা নিয়ে হালকা অ্যাংজাইটিও হয়েছে আমার। এর মধ্যে কবে যেন স্বপ্ন দেখলাম— বারান্দায় ভোরের এক টুকরো রোদ পড়েছে। আমার এক হাতে ডাব্বা চায়ের কাপ, অন্য হাতে খবরের কাগজ। পাঁচের পাতায় এক কলামের হেডলাইন দেখেই আঁতকে উঠলাম। হেডলাইন এইরকম— ‘পরকীয়ার জের, হ্যান্ডু মন্টুর হাত ধরে ঘর ছাড়ল লেখকের বউ’।
আর্তনাদ করে উঠলাম আমি—‘ঋতু-উউউউউ…!’ ওমনি এক ঠেলা! চোখ খুলতেই সামনে খুন্তিধারিনী। আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে ঋতু। খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘সক্কাল সক্কাল পাড়া জানিয়ে ডাকছ কেন? হয়েছেটা কী? যত্ত আদিখ্যেতা!’ আমি অবশ্য লজ্জায় স্বপ্নের ব্যাপারটা বলিনি।
তবে কিনা মন্টু আর তার দলের গরু খোঁজার বিষয়টা মোটেও স্বপ্ন না। ঘোর বাস্তব। প্রথম টের পাই গতকাল। কলেজস্ট্রিট থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল কাল আমার। তার উপর পাড়ায় ঢোকার মুখেই দোতলা ‘ঝিনচ্যাক ক্লাব’। ভয়ে ভয়ে জায়গাটা ডিঙোচ্ছি। ওই বলে না, যেখানে ভূতের ভয়, সেখানেই ইয়ে হয়! ‘আরে দাদা যে! আমাদের পাড়ার গর্ব। আপনাকেই খুঁজছিলাম। বাড়িতে গেছিলাম। বউদি বলল কলেজস্ট্রিট।’ আমার সামনে মূর্তিমান মন্টু! গেরুয়া পাঞ্জাবি, কপালে তিলক, দশ আঙুলে আটখানা আংটি। গলায় রুদ্রাক্ষ। দেখলেই কেমন গা ছমছম করে। সাধু সন্ন্যাসীরাও এই সব পরেন বটে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ভোল বদলানো মন্টুর এই চেহারা দেখলেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।
যদিও মন্টুর গর্তে ঢোকা চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকে হাসলাম আমি। চ্যালাগুলোও পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁরাও বলল, ‘আপনি ছাড়া তো হবে না দাদা।’
আমি নরম করে বললাম, ‘কী হবে না ভাই? আবার বসে আঁকো? আবৃত্তি প্রতিযোগিতা? বিচারক হতে হবে?তোমরা বললে নিশ্চয়ই থাকব।’
মন্টু আরও দু’পা এগিয়ে যাকে বলে মুখোমুখি। ঝাঁঝাল মদের গন্ধে ভিড়মি খাওয়ার অবস্থা আমার। বোধ হয় অস্বস্তিটা আন্দাজ করল। ব্যাকগিয়ার মেরে খানিক পিছিয়ে বলল, ‘সে পাঙ্গা না দাদা। ঢের বড় ব্যাপার। দেশের গর্ব। মহাবিশ্বের অহঙ্কার। আপনি জানেন না তা তো হতে পারে না!’
ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘কোন ব্যাপারটা বলো তো?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে মন্টু বলল, ‘কেন, চন্দ্রযান! কালই তো ল্যান্ড করছে। একটা সেলিব্রেশন হবে না মাইরি।’
মন্টুর মুখে চন্দ্রযান নিয়ে ভালো কথা শুনে অবাক হলাম আমি। মুখে বললাম, ‘সে তো ভালো কথা। অবশ্যই দেশের গর্ব। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের বিরাট জয়। তা কী করতে চাও তোমরা?’
‘কাল চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান নামার পরেই গোমাতা পুজো করব আমরা। প্রধান অতিথি আপনি। বেশি কিছু না। আসবেন, পুজোয় স্টার্ট দেবেন, পুজো সম্পূর্ণ হলে ছোট স্পিচ ঝাড়বেন, ব্যাস, ছুটি।’
ঢোক গিললাম আমি। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘চন্দ্রযান একটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। তার মধ্যে গরু পুজো! ব্যাপারটা কি ভাল হবে!’
মন্টু গলায় হালকা ঝাঁঝ এনে বলল, ‘আপনি দেখছি আচ্ছা ইয়ে লোক মশাই। বিজ্ঞানীরা যেখানে পুজো দিয়ে রকেট ছাড়ছে, আমরা গোমাতার পুজো করলেই ক্যাওড়া।’
মোক্ষম যুক্তি। এর পর কথা বলা যায় না। অতএব, মন্টুই বলে গেল, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে। খালি গরু নিয়েই যা কেলো।’
আমি আফসোসের সুরে বললাম ‘ওঃ।’
মন্টু বলল, ‘ভাবুন একবার, রোজ দুধ খাচ্ছি। রসগোল্লা সাপটাচ্ছি, ঘি-মাখন-পনির কতকত করে গিলছি। অথচ আশপাশের তিন-চারটে পাড়া খুঁজে একটা গরু পেলাম না মাইরি!’
আমি গলায় দরদ এনে বললাম, ‘কথায় বলে গরু-খোঁজা, তা খুঁজছ যখন ঠিক পেয়ে যাবে।’
মন্টুর এক চ্যালা বলল, ‘গরু একটা ম্যানেজ করবই। দরকার হলে গোবলয় থেকে আমদানি করব। দেশে না পেলে নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া থেকে আনব।’
মন্টু ধমক দিয়ে বলল, ‘থাম!’ আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘তাহলে এই কথাই রইল দাদা। গরুর ব্যাপারটা আমরা দেখছি। আপনি সময় মতো ক্লাবপ্রাঙ্গনে চলে আসবেন। অবশ্যি বাড়ি আনুষ্ঠানিক নেমোতন্নও করব।’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে হয়েছিল। এখন বাথরুম বসে ফিসফিস করল আমার দুর্বল হৃদয়, ‘তাহলে গরু পেয়ে গেছে ওরা! সেই কারণেই নব উৎসাহে বাড়ি অবধি আগমন। এত করে ঠাকুরকে ডাকলাম, তাও পেয়ে গেল!’
এর মধ্যেই ঋতু চেঁচাল, ‘কী গো! মন্টু বসে আছে তো! কতক্ষণ অপেক্ষা করবে ওরা?’ অগত্যা কোমোডে একটা ফ্ল্যাশ মেরে ঠোঁটে দু’ইঞ্চি হাসি ঝুলিয়ে বাইরে বেরোলাম।
আমাকে দেখামাত্র মন্টু বলল, ‘শুনলাম বউদির থেকে। চাপ নেবেন না দাদা। দু’বেলা দুটো কাঁচকলা মেরে দিন। ছিপি এঁটে যাবে। তাছাড়া আমরা আছি তো।’
গদগদ ভঙ্গিতে বললাম, ‘তা তো বটেই। কিন্তু গরু?’
মন্টু উত্তর দিতে গিয়েও থমকালো। কারণ পাঁচ কাপ চা আর পাঁচ দুগুণে দশটা বিস্কুট ট্রেতে সাজিয়ে ঋতু হাজির। মহিলার কৌতূহলও বিরাট! মন্টুর দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘কোন গরু? কেন গরু?’
আমিই বললাম, ‘চন্দ্রযানের গরু। তুমি বুঝবে না।’
চায়ে চুমুক দিয়ে মন্টু বলল, ‘একটা গরু তো চাই বৌদি। সন্ধে ছটায় চাঁদে নামবে মহাকাশযান। তারপর গোমাতাকে পুজো দিয়ে সেলিব্রিশেন। কিন্তু গরু পাচ্ছিলাম না জানেন। শেষতক ম্যানেজ করেছি।’
মন্টু ম্যানেজ করেছি বলতেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ‘যাহ!’ টেরিয়ে তাকালো চ্যালাগুলি। আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘তাহলে তো ঠিকই আছে।’
মন্টু বলল, ‘হ্যাঁ। ব্যবস্থা পাকা। সন্ধেবেলা সময় মতো চলে আসবেন দাদা।’ ঋতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উইথ বৌদি। এত বড় ব্যাপার। সবার থাকা উচিত।’ ঋতুও একগাল হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
ঝিনচ্যাক ক্লাবের সামনে এক খাবলা ছোট মাঠ। সন্ধেবেলা সেখানে সস্ত্রীক পৌঁছতে বাধ্য হলাম। কারণ মিশন চন্দ্রযান সফল হয়েছে। বলা বাহুল্য, ঐতিহাসিক ঘটনা। গোটা দেশে উৎসবের আমেজ। পঞ্চাশটা টিভি চ্যানেলে শ’খানেক বিজ্ঞানীর প্যানেল বসেছে। সকলেই আকাশছোঁয়া সাফল্যের ব্যাখ্যা করছেন। আমারও ভালো লাগছে। বহুদিন পর রাজনীতি, ধর্ষণ, খুন, ক্রিকেটের বাইরে একটা ভালো খবর নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
যদিও মন্টুদের ব্যাপারটা আলাদা। ঝিনচ্যাক ক্লাবে যেতে হবে, এই ভেবে বিকেলে শক্তি চাটুজ্যে রিপিট হচ্ছিল আমার- ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’ ঋতুই বোঝাল ‘কেন’। বলল, ‘কথায় কথায় পাড়ার ছেলেদের বিরুদ্ধে যাওয়া মোটে বুদ্ধিমানের কাজ না। তাছাড়া তোমাকে ওরা পাত্তা দেয়। এর মধ্যে খারাপ কী আছে!’
অতএব, আমি এখন প্রধান অতিথির লাল রঙা প্লাস্টিক চেয়ারে। মাথার উপরে উড়ছে স্যাঁদলা ত্রিপল। জ্বলছে হ্যালোজেন, টিউব। সামনে ছোট ভিড়। কাছে-দূরে ফুট-ফটাস বাজি ফাটছে। সেই সব শব্দকে ছাপিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে মাইক ফুঁকছে খোদ মন্টু। আবেগে ওর গলা কাঁপছে, ‘বন্ধুগণ, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কী, এমন প্রশ্ন তোলার দিন শেষ। কারণ আমরা সচমুচ চাঁদে পৌঁছেছি। সাংবাদিকরা বলছে যে আমেরিকা,রাশিয়া, চিনকে ওভারটেক করেছি। অতএব, ঋষি কাপুরের কায়দায় আমরা এখন বলতেই পারি— ও মেরে চাঁদনি, তু মেরে চাঁদনি।’
মন্টুর বক্তৃায় জোর হাততালি পড়ল। আমিও মনে মনে বললাম, ‘যতটা অশিক্ষিত ভাবি, ততটা না।’
মন্টু চালিয়ে গেল, ‘আজকে আমরা এখানে জড়ো হয়েছি দেশের সাফল্য় সেলিব্রেট করতে। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন এলাকার গর্ব সাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ সেন। প্রিয় ইন্দ্রদা! চাঁদ যদি পৃথিবীর রাতের আলো হয়, ইন্দ্রদা তবে আমাদের পাড়ার হাই ভোল্টেজ হ্যালোজেন।’ ফের এক চোট হাততালি পড়ল। চেয়ারে বসেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে হাতজোড় করলাম আমি। মন্টু বলে গেল, ‘ইন্দ্রদাকে গাদা ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেবে ঝিনচ্যাক ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ ভজা, মানে ভজেন্দ্র দেবনাথ।’
মোটাসোটা ভজা আমার দিকে হস্তি চালে এগোচ্ছে। হাতে গাদার মালা। কিন্তু গরু কোথায়? ‘গোমাতা পুজোর আগেই আমাকে মালা পরানো কি ঠিক কাজ হবে?’ পাশে দাঁড়ানো মন্টুকে ফিসফিস করে বললাম আমি। মন্টু মুচকি হেসে হাতের ইশারায় মালা গ্রহণ করতে বলল। উঠে দাঁড়িয়ে গলা বাড়ালাম। তখনই শুনতে পেলাম—ম্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্য়া… পিলে চমকানো ডাক।
প্রাথমিক আতঙ্ক সামলে তাকিয়ে দেখি, মন্টুর দলের দুজন একটা নধর ছাগলকে ঠেলতে ঠেলতে ত্রিপল ঘেরা চত্বরের দিকে নিয়ে আসছে। মনে মনে ভাবলাম, মন্টুরা তাহলে রাতের পিকনিকের ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। বলা বাহুল্য, মেনু হবে পাঠার মাংস-ভাত। কিন্তু না, আমার অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। মাঠশুদ্ধু লোককে চমকে দিয়ে আজব ঘোষণা দিল ঝিনচ্যাক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মন্টু। জানাল যে হাজার চেষ্টার পরেও, সাত মুল্লুক ঘুরেও, অর্থাৎ কিনা গরু-খোঁজা খুঁজেও গরু পাওয়া যায়নি। তাই বিকল্প হিসেব ছাগলের ব্যবস্থা হয়েছে।
এমন কথা শোনামাত্র গুঞ্জন শুরু হল মাঠে। বোঝা গেল ব্যপারটা অধিকাংশ লোকেই মানতে পারছে না। সবচাইতে বেশি সমস্য়া হল কানা বাড়ুজ্যেকে নিয়ে। একচোখে পাথর বসানো বাড়ুজ্যে সাফ জানালেন, ছাগলপুজোর মতো অশিষ্ট কাজ প্রাণ থাকতে করবেন না। একথা বলে কোঁচা তুলে হাঁটা দিলেন প্রবীণ পুরোহিত। মন্টুর চ্যালারা ছাড়া বাকি ভিড় কানা বাড়ুজ্যেকেই সমর্থন দিল। এবং তার পিছন পিছন ঘরমুখো হাঁটা দিল। ঘটনার আকষ্মিকতায় ডাকসাইটে চরিত্র মন্টুও দেখলাম কেমন ভেবলে গেছে! তড়িঘড়ি খেয়ে আমাকে বলল, ‘পুজোর নিকুচি করেছে। দাদা আপনিই ছাগলটার গলায় মালাটা পরিয়ে দিন। তাতেই অনুষ্ঠান সমাপ্ত হবে।’
মন্টুর এক চ্যালা মালা এগিয়ে ধরল আমার দিকে। আমি দোনামনা করছি। ভাবছি, এই সুযোগে আমিও কি কানা বাড়ুজ্যের মতো ডাঁট দেখিয়ে বাড়িমুখো হাঁটা দেবো! কিন্তু এতক্ষণ আমার সঙ্গে থেকেও না থাকা ঋতুর মুখে হঠাৎ বুলি ফুটল। নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আমি মালাটা পরিয়ে দিই। আমার না, ছাগল খুব কিউট লাগে।’
মন্টু অমনি গদগদ, ‘নো প্রবলেম, বউদিই তবে…।’ আপত্তি করলাম না আমি। ফাঁকা মাঠে ছাগলের গলায় মালা দিল ঋতু। ছাগলটা বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে কিংবা তুমুল আনন্দে ম্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্য়া… ডাক ছাড়ল। গগন বিদারী ডাক।
সেদিন মধ্যরাতে বিছানায় শুয়ে ওরকম ডাক আরও একবার শুনলাম আমরা। পাশ ফিরে ঋতু বলল, ‘ছাগলটা অমন ডাকছে কেন বল তো।’
আমি বললাম, ‘যতই হোক ছাগল তো, বোধ হয় এতটা সম্মান পারে আশা করেনি।’
ঋুত বলল, ‘ইয়ার্কি করো না।’
আমি বললাম, ‘হতে পারে খাওয়ার জিনিস গলায় দেওয়া পরানো হল কেন, এটা ভেবে আতঙ্কিত বেচারা। ধরো, তোমার গলায় যদি কেউ মাটন বিরিয়ানির মালা পরায়, তুমি আতঙ্কিত হবে না?’
ঋতু হাই তুলে বলল, ‘তাও ঠিক!’
পরদিন সকালে খবরের কাগজের জন্য অতি উৎসাহে অপেক্ষা করছিলাম। চন্দ্রযানের সংবাদটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়ব বলেই। অথচ সময় মতো কাগজ এল না বাড়িতে। সাড়ে দশটা নাগাদ এল কাগজওয়ালা নাড়ু। জানাল পেট খারাপ। তাই দেরি। বললাম, ‘কেন রে? কী খেয়েছিলি?’
নির্লিপ্ত নাড়ু জানাল, রাতে মন্টু জোর করে ঝিনচ্যাক ক্লাবের পিকনিক নিয়ে গেছিল ওকে। বেশি রাতে পাঠার মাংস-ভাত খেয়ে সকাল থাকে পিচকিরি। পেটে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেল নারু। খেয়াল করিনি কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঋতু। নারুর কথা শুনে বুঝে গেছে কী কাণ্ড হয়েছে রাতে। মুখ কাঁদো কাঁদো। বলল, ‘ছাগলটা কিন্তু কিউট ছিল!’ ওমনি গা-হাত-পা রি-রি করে জ্বলে উঠল আমার। ছাগলের আবার কিউট কী! মন্টুর ছাগল বলেই কি ঋতুর খানিক বেশিই কিউট মনে হচ্ছে! কই আমার কোনও জিনিসকে তো কিউট বলতে শুনিনি! তাহলে কি ওই বিচ্ছিরি স্বপ্ন সত্যি হবে—‘পরকীয়ার জের, হ্যান্ডু মন্টুর হাত ধরে ঘর ছাড়ল লেখকের বউ!’