ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটবেলা,
শোন, যতই পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই, ততই ছায়ার মতো আরও বড় হয়ে ধরা দাও তুমি। আলোর দিনে তোমায় বড় একটা মনে পড়ে না, যতটা তোমায় পাই বৃষ্টির ফোঁটার প্রিজমে। মেঘের বুকচাপা বিষাদে। হিন্ডেলিয়ামের ছোট্ট বাটিতে গোলাপি লাক্সের সাবান, ওষুধের ধোয়া শিশিতে ঘানিভাঙা সর্ষের তেলের চড়া গন্ধ, শ্বেতপাথরের খলে মধু মাখা হরেশ কবরেজের পুরিয়া, দুটো চালের চৌকো টিনের বাক্সে ভারী ক্ষীরোদের দু’কাঁধে বয়ে আনা বিলাসের কলের জল, উঠোনে কার্পাস-শিমুলতুলো, ধুনেপেটানো শীতের নতুন লেপের ওম, ফ্রিল দেওয়া ঘটিহাতা জামা, ম্যাক্সি-কাফতান-বেলবটম পার হয়ে আমি এখন হিল পায়ে জব্বর আধুনিকা। ওসব ‘অস্বীকার‘ করতে চাইলেও আমার সেরা সময়টা ‘বন্ধক’ রয়ে গেছে সেখানেই। অনেক সুদের উৎকোচকে কাঁচকলা দেখিয়ে তুমি রাতজাগা জটায়ু পাখি হয়ে দু’পাখা দিয়ে পাহারা দাও সেসব দিন। আর গুণগুণ করে গাও সেই গান— ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার’। আমার মাথা লংপ্লেইং রেকর্ডের মতো গেয়ে যায় সেই গান।
তবে সব ছাপিয়ে ছেলেবেলার সব হাসি-কলকলের ধুলো ঝেড়ে মনে পড়ে কালো খামের মতো একটা দিন… যে দিনের ‘ঠিকানা -চাবি’ কখনই দাওনি তুমি আমায়। হিসেব তো নয়ই। সেদিন — বৃষ্টি-খিচুড়ি-কুমড়ো ফুলের বড়া, বেতের ডগা ভাজা, ঘরভরা ঠাসা আত্মীয়স্বজনে। এত হাসি-আনন্দের মাঝে কোথা থেকে এত ‘ভালো না লাগা’ – কান্না চেপে ধরেছিল আমায়? আজও খুঁজে কোন উত্তর পাইনি কোথাও। বড়রা সবাই বলেছিল— “এইটুকু মেয়ের আবার ভালো লাগে না মানে কী, শুধু পাকা পাকা কথা। বেশি বেশি ঢং!” এমন অজানা বোধে কখনও জর্জরিত হইনি আগে! এই অচেনা আমিকে দেখে খুব ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছি সেদিন। তাই ‘সব ভালো’-র সেই দিনটি থেকে নিজেকে আলতো করে তুলে নিয়ে খেয়েদেয়ে কেঁদেকেঁটে একা একা ঘুমিয়ে পড়েছি সেদিন। ঘুমের রাজত্বেই যেন পেয়েছিলাম সেদিন পালাবার একমাত্র পথ। তার আগের মুহূর্ত অবধি জ্বর-ঘুষঘুষে একটা অবাধ্য-দামাল-বিস্বাদ মন; যাকে কোলে-পাশে কোথাও বসিয়েই সামাল দিয়ে শান্ত করা যাচ্ছিল না। ঘুম থেকে উঠে আবার সেই ফর্সা ফুটফুটে দিন। আবার সেই চিরচেনা আমি।
আজ ছোট থেকে প্রমোশন হয়েছে বড়-তে । একটা ইয়া লম্বা বহু ইঞ্চির বড়বেলার জীবনে এমন ‘মাইলস্টোন’ আসেনি যে আগে আর, তা নয়। কিন্তু এত বিদ্যুৎস্পৃষ্টতাবোধ ছিল কি তাতে? না হয়তো। কারণ তদ্দিনে লেপের তাঁবুতে নয়, ঘুমের সাম্রাজ্যে নয়, তরোয়াল হাতে সেই মনখারাপকে খানখান করে জীবনকে আরও বেশি করে জাপটে ফিরে আসার মন্ত্র শিখে ফেলেছি যে— বড়বেলার কাছ থেকে। তবু ছেলেবেলার ওই বিশেষ দিনের ভয় কামড়াতে আসত মাঝেমাঝে। আর অমনি বড়বেলা ঢাল হয়ে এই বৈরাগ্যকে আমল না দিয়ে আমায় বৈরাগী হওয়া থেকে রক্ষা করত দু’হাতে। ভাগ্যিস! আমি ভাবি সদ্যোজাত শিশুর মায়া কাটানো নিষ্ক্রমণের বুদ্ধকে তাঁর বড়বেলা কাঁধে হাত রেখে বোঝাতে না পেরে অসহায়ভাবে কেঁদেছিল হয়তো সেদিন। আমরা শুধু শুনতে পেয়েছিলাম রাহুলের কান্না।
আমি জানি আমার বড়বেলা তোমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে, হাতে হাত রেখে সব ‘মিটমাট’ করে ফেলেছিল সেদিন। আমিই শুধু এদ্দিন মুখোমুখি হইনি তোমার। প্রথম ভয়, প্রথম প্রেমের কথাই সবাই বলে। প্রথম ডাউনফলের কথা সবাই ভুলতে চায় যে। জীবনের কুইজে অনূহ্য থাকাই তার নিয়তি। আজ এই খোলা চিঠিতে ভারমুক্ত আমি চললুম ডানা মেলে উড়তে আকাশে। আদর তোমায়, বিমানবন্দর অবধি তুমি এলে— আমায় তুলে দেবে বলে। বড়বেলার আমার ধন্যবাদ জেনো তুমি— ‘আমার ছোটবেলা’।
আমার স্বপ্নের লেন্সে ধরা থাকবে তুমি চিরদিন। মোবাইলে মাঝে মাঝে ফোন কোরো। তুমি শুনবে… আমার রিংটোনে বাজবে আমার পছন্দের সেই সেট করা গান—
“দুঃখ বলে, ‘রইনু চুপে
তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে।’
আমি বলে, ‘মিলাই আমি
আর কিছু না চাই’।”
ইতি
তোমার ছোটবেলার খোলস ভাঙা
বড়বেলা