ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
সেই শৈশবখানা,
বাড়ির পাশেই বিরাট একটা মাঠ, সবুজ গালিচাপাতা, চু-কিত-কিত কিংবা গোল্লাছুটের চিল-চিৎকারে কান পাতা দায়! মাথার উপর ভনভন করছে মশা, জামা ভর্তি চোরকাঁটা। ছেলেমেয়েগুলোর পা-ভর্তি ধুলোবালি, ঘামে জ্যাবজ্যাব করছে শরীর। ওই এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের মধ্যে বয়কাট চুলের রোগা প্যাকাটি মেয়েটাকে মনে পড়ে তোর?
আর ওই বিরাট লিচু গাছটা? কত লুকোচুরি খেলার যে সাক্ষী ওই গাছটা, মনে আছে তোর?
চোখ বুঝলে কত কথাই না মনে পড়ে যায় এক এক করে, যেন এই তো সেদিনের কথা, অথচ মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে কত কত দিন, কত কত বছর!
দিদিভাইয়ের রঙচটা যাওয়া সাইকেলটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম, তখন আমার ক্লাস ফাইভ। ধু-ধু দুপুরে মাকে লুকিয়ে পাশের বাড়ির বোনটিকে পিছনে বসিয়ে চলে গিয়েছিলাম অজানা এক রাস্তায়। ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। আজও সেই পথ দিয়ে গেলে সেই দুপুরের কথা মনে পড়ে যায়।
বাড়ির সামনে একটা বকুল গাছ লাগিয়েছিল বাবা, একবার কলকাতা থেকে ফেরার পর দেখি ছাগল গাছটিকে মুড়িয়ে খেয়ে নিয়েছে। মনে হয়েছিল নিজের শরীর থেকে কোনও অঙ্গ কেটে নিয়েছে কেউ। তারপর থেকে ওই গাছের যত্ন করা বেড়ে গিয়েছিল আমাদের। সেই গাছ দেখতে দেখতে আমাদের মাথা ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। মনে পড়ে ওর নিচে বসেই শুরু হয়েছিল আমার প্রথম ছড়া লেখা। আজও ছোটবেলা বললেই ওই গাছটার কথাই আমার মনে পড়ে, জানিস?
শৈশব জুড়ে কত স্মৃতি, অথচ অ্যালবমের পাতার মতো তা ঝাপসা হয়ে যায়নি, বরং মনের পাতায় আজও সেসব জ্বলজ্বল করে। বাড়ির বিরাট উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলার ঘর, ক্রিমের কৌটো দিয়ে বাবার বানিয়ে দেওয়া দাঁড়িপাল্লা। উঠোন জুড়েই বসত মুদিখানার দোকান, বালি, মাটি, পাথর আর গাছের পাতা, তা দিয়েই চাল, ডাল, লবনের দোকান, গাছের পাতা কিংবা কাগজ কেটে বানানো টাকা। প্রাইমারি স্কুলে যে টিনের বাক্সটা নিয়ে যেতাম তাতেই সেই নকল টাকা, পুরোনো লটারি, বিভিন্ন আকারের পাথর জমিয়ে রাখা, মনে আছে এসব তোর?
ছোটবেলায় কনডাকটর হতে চেয়েছিলাম। পাশের বাড়ির কাকুর ছিল লটারির দোকান। পুরোনো লটারিগুলো তিনিই সাপ্লাই দিতেন। লম্বা ভাঁজ করে আঙুলের ভেতর ঢুকিয়ে বাস বাস খেলতাম। বাড়িতে কেউ এলেই তাঁকে টিকিট কেটেই ঢুকতে হত। কী যে মজা লাগত তখন! আজ প্রতিদিন বাসে যাওয়া আসার পথে কখনও সেসব খেলার কথা মনে পড়ে যায়। তুই এসব মনে রেখেছিস?
খুব দুষ্টুমি করলে মা বইপত্র সাজিয়ে বাইরের ছোট্ট ঘরটায় বসিয়ে দিত, মনে আছে? বইয়ের দোকান দোকান খেলতাম তখন। মা, বাবা, দিদিভাই এসে বারেবারে নানা বই চাইত, আর আমি মহানন্দে তা খুঁজে বের করে দিতাম। কখনও বা মাথা চুলকে বলতাম, নাহ, এই বইটি নেই, আপনি চাইলে আনিয়ে দিতে পারি। বইয়ের প্রতি প্রেম তো তখন থেকেই শুরু। জানিস না তুই?
আজ যখন পিছন ফিরে তাকাই, দেখি কত কী যে ফেলে এসেছি চলার পথে। আর ফিরে গিয়ে কুড়িয়ে নেওয়ার উপায় নেই। ফেলে এসেছি আমার পুতুল খেলার ঘর, লটারি ভর্তি টিনের বাক্সটা, একটা মাউথ অর্গান, লিচু গাছ, বকুলতলায় বসে লেখা প্রথম ছড়ার খাতাটা, ফেলে এসেছি একদল ছেলেমেয়ে, যারা এখন কেউ থেকেও নেই, কেউ হারিয়ে গেছে আমার চেনা পথঘাট থেকে, কেউ বা শুধুমাত্র ফোন নম্বরে বেঁচে আছে। তাঁদের গলা শুনতে পাই না আর, আমিও তাঁদের মতো সকাল রাতে শুভেচ্ছার মেসেজ পাঠাই সোশ্যাল মিডিয়ায়, আন্তরিক ডাকটা কতদিন শুনি না।
সেই শৈশবের পথঘাটগুলো সব বদলে গেছে। চিরচেনা হলেও কেমন যেন অচেনা ঠেকে! তবু মাঝেমধ্যে অলস অন্যমনে ওইসব পথঘাট, বদলে যাওয়া মাঠটার দিকে তাকালে সেই বয়কাট চুলের রোগা প্যাকাটি চেহারার লাজুক মেয়েটার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায় আচমকাই। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ! চেনা চেনা লাগে? ভাবি, আদৌ কি চিনি ওকে? নাকি এ আমার মনের ভুল?
আমার প্রিয় সেই শৈশবখানা, তোর মনে আছে ওই মেয়েটাকে? কোনোদিন যদি ওর সঙ্গে দেখা হয় বলিস ওর কথা বড্ড মনে পড়ে। ওকে বলিস আমার সেই শৈশবের ঠিকানায় যেন দেখা করে কোনও একদিন।