ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
মাই ডিয়ার ডিয়ারেস্ট…
কী বলত যেন শচীন? মাই ডিয়ার, ডিয়ারেস্ট অঞ্জলি। সেই যে, দূরদর্শনের প্রথম প্রথম কর্মাশিয়াল ব্রেকে চিঠি লিখতে লিখতে কিশোর ক্রিকেট তারকা ঠান্ডা পানীয়ের তেষ্টায় ছটফট করে উঠত? বাবা, এ সম্বোধন তো চাট্টিখানি কথা নয়! লিখতেই ওইটুকু। মেয়েদের মধ্যবিত্ত ইস্কুল, তায় আবার কড়া পরম্পরা, প্রতিষ্ঠা, অনুশাসনের মেয়েদের ইস্কুল। তো কে তার মধ্যে কার ডিয়ার, আর কে কার একটু বেশি ডিয়ার আর কে ডিয়ারেস্ট, তাই নিয়ে হাসি কান্নায় হিংসুটে কতদিন কাটিয়েছিস মনে আছে? নেই! ওরে সোমা, সুচন্দ্রা, স্বাতী, পদ্মপাতায় জল সেইসব ভালোবাসা গড়িয়ে কোন দিঘিতে তলিয়ে গেল খবর রাখিসনি?
জানি তো ভুলে মেরেছিস। উলোঝুলো বরাবরের মতন কতদিন টিফিন খেতেই ভুলে যেতিস, কত বই খাতা পেন ভুলেছিস। সেবার শুভ্রাদি ক্লাসে এসে বললেন সারপ্রাইজ টেস্ট, ম্যাপ পয়েন্টিং। যথারীতি বাড়ি থেকে ম্যাপ আনতে ভুলে গেছে অর্ধেক ক্লাস।
এদিক ওদিক থেকে এক্সট্রা ম্যাপ কিছু জোগাড় হল, সবকটা হাত ঝাঁপিয়ে পড়ল। তুই পিছিয়ে গেলি, ভাবলি যাচ্ছে তো ও, আমারটা জোগাড় করে আনবে। আমি আনলাম বটে, তবে শেষ ম্যাপটা। নাচতে নাচতে, নিজের জন্য। শুভ্রাদি কঠিন গলায় বলছেন, “দেখে নাও সুচন্দ্রা, এত বন্ধুত্ব এত ভালোবাসা তোমাদের, সব একটা দশ নম্বরের পরীক্ষার কম্পিটিশনে ভেসে গেল। দেখলে তো?”
মনে নেই। জানি। ভালোবাসা মানচিত্রের দায়ে পালটে যায়, এ কথা বোঝার বয়স আমাদের ছিল? কোলাইটিসের বিশ্রী অসুখ নিয়ে টলতে টলতে অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিতে এসেছিলি যখন সারা ক্লাস একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, “হ্যাঁ রে সোমা কেমন আছে?” আমি রেগে যাচ্ছি। কেন ওরা আমার সামনে ওই নাম নেয়? ওর ওপর ভীষণ ভীষণ রেগে আছি আমি, তা কি কারও জানতে বাকি আছে? কেন রেগে আছি তার কোনও সঠিক কারণ ছিল না। হয়তো লেখাপড়ায় অতটাও এগিয়ে থাকত না, তাই? হয়তো বোর হয়ে গিয়েছিলাম? পিটি পরীক্ষার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরেছিলাম, ওইটুকুই। রুগ্ন অভিমানী চোখজোড়া অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিল, হয়তো ভেবেছিল একটা অন্তত কুশল প্রশ্ন আসবে একদা প্রিয় বন্ধুর থেকে। বরং এসেছিল একটা বিরক্ত ধমক।
“একা একা ঘুরে বেড়ানোর কি খুব দরকার? যত্তসব!”
অসুখ সেবারে সেরে গিয়েছিল। আবার কিছু অসুখ সারেও না। এই যে তুই, আরে তোকেই লিখছি। স্বাতী। ডাকাবুকো টমবয় হয়ে খেলার মাঠ থেকে পরীক্ষার খাতা দাবড়ে বেড়াতিস। তোর বেশিরভাগ তর্কের উলটোদিকে আমি, আর আমার উলটোদিকে তুই। প্রবল ঝগড়ার সময় একদিন দেখলাম ঝরঝর করে কাঁদছিস। কবে কাকে বলেছি স্বাতী আমাকে হিংসে করে। সে কথা তোকে লোকজন শুনিয়ে দিয়েছে। তারাও কারও ডিয়ার, কারও ডিয়ারেস্ট। আছাড় খেয়ে ছালবাকল তুলেও হিহি করা দস্যি মেয়েদের ঠিক কোথায় লাগলে আঘাত জোরালো হয়?
কিল মারার গোঁসাই ভাত না হোক, আদর দিতে কি জানত না? এই যে শ্রীপর্ণা, নিজে অ্যানিমিক হয়েও নিজের পাউরুটি ডিমসেদ্ধ আমাকে খাইয়ে দিতিস, পরীক্ষার আগে নিজের ঘড়ি খুলে আমার হাতে বেঁধে দিলি, সেইসব সময় বাঁধতে পারলি কোথাও? এমনই এক হেমন্তে দুজনের সময় আলাদা হয়ে গেল, মনে আছে সেসব সাতকাহন?
ভাগ্যিস এ চিঠি কখনও ডাকবাক্সে ফেলতে পারব না!
এই শর্ট এসওএসের যুগে মান্ধাতার আমলের চিঠির জন্য কোনও আহাম্মক বসে থাকে না। তাই নিশ্চিন্তে বলে রাখি, এই যে এত এত ভালোবাসা দিলি আমাকে, তাও কে ডিয়ার আর কে ডিয়ারেস্ট কখনও জানতে পারলি?
তোরা এমনি করে আশকারা, ভালোবাসা, সাহচর্য দিয়ে একটা গোটা শৈশব আর টিনএজ আলো করে রেখে গেলি। আর তারপর ভুলেই গেলি। এ প্রাসাদের এখন আমিই কেয়ারটেকার, আমিই মালিক। পদ্মপাতায় যেসব স্মৃতির টুকরো তুলে রাখি, সবটুকু জল নয়, কিছু কিছু জমে স্ফটিক হয়ে যায়। রেখে দিয়েছি। এ প্রাসাদে এলেই দেখতে পাবি, আলো ঝলমল করছে। হয়তো দেখবি যে ডিয়ার সেই একদিন ডিয়ারেস্ট হয়ে যায়?
ইতি
খারাপ বন্ধু