ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
মাই ডিয়ার ছোটবেলা,
‘কেমন আছ?’ বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই, আয়নার সামনে, চুপচাপ। দেখি চুলে পাক ধরেছে, চামড়ায় কালো ছোপ, মুখে বলিরেখা। কী খুঁজি? কাকে খুঁজি? ওই স্কুলড্রেস পরা, দুদিকে বিনুনি বাঁধা মেয়েটাকে? আয়নার ওপার থেকে এক বড়বেলা যেন মলিন হাসে। বুকের ভেতর কুঁকড়ে থাকে আমার মেয়েবেলা।
হ্যাঁ, কুঁকড়ে থাকে। আমাদের মফস্সলের মেয়েদের বড় হয়ে ওঠার আড়ালে লুকিয়ে থাকে একরাশ ভয়, কুণ্ঠা, লোকে কী ভাববে, লোকে কী বলবে, মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে ইত্যাদি ইত্যাদি নানান চোখরাঙানির এলোপাথাড়ি বিবমিষা। সেগুলো কখনও অতিক্রম করে, কখনও সঙ্গে নিয়েই বেড়ে উঠি আমরা মফস্সলি মেয়েরা । আর সেই অজানা ভয়ের ট্রমা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে অদৃশ্য ভাবে সঞ্চারিত হতে থাকে ।
একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে– তখন আমার ক্লাস টেন, সামনেই মাধ্যমিক। যে গৃহশিক্ষকের কাছে বাংলা পড়তাম, তিনি চাকরি পেয়ে হঠাৎই পড়ানো ছেড়ে দেন। ফলে মা তাড়াহুড়ো করে আমার মামার পরিচিত এক বন্ধুস্থানীয় ভদ্রলোককে (যদিও তিনি ভদ্র কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে) অনুরোধ করেন, তিনি যেন আমায় পড়াতে রাজি হয়ে যান। ঘটনাচক্রে, তিনি রাজি হলেন । পড়াতে আসা শুরু হল। ধীরে ধীরে দেখলাম তিনি প্রায়শই পড়াতে পড়াতে কখনও আমার হাতে বা ঊরুতে হাত রাখেন। ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয়, তা আমি ভালোই টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু কী করা উচিত তা বোঝার মতো বা প্রতিবাদ করার মতো ম্যাচিওরিটি বা মানসিক দৃঢ়তা তখনও তৈরি হয়নি ।
এভাবেই মুখ বুজে চলছিল। একদিন উনি হঠাৎ পড়াতে পড়াতে আমার পাশে এসে বসে পড়েন এবং তারপর ঘাড়ে হাত দিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠি। মা আমার আওয়াজে ছুটে আসেন রান্নাঘর থেকে। ততক্ষণে তিনি সরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়েছেন, আর মাকে বললেন, ‘ও কিছু না, ওই একটা মাকড়সা ওর গায়ের ওপর এসে পড়েছিল বলে ভয় পেয়েছে বেচারি।’ বলে খ্যাক খ্যাক করে হেসে যাচ্ছে লোকটি। আমি থরথর করে কাঁপছি তখনও। কিছু বলার অবস্থায় নেই। মা চলে যায়। তারপর উনি আমায় রাগান্বিত চোখে হুমকি দেন, এ-কথা যদি আমি আমার মাকে বলি তাহলে উনি আমায় পড়ানো ছেড়ে দেবেন এবং আমার মামার কাছে আমার চরিত্রের গুষ্টিশ্রাদ্ধ করবেন। আমিও কেমন ভয় পেয়ে গেলাম, উনি যদি মামাকে কিছু উল্টোপাল্টা বলেন আমার সম্বন্ধে! মামা কী ভাববেন? আত্মীয়দের মধ্যে সব জানাজানি হবে, মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না। আর সামনেই মাধ্যমিক, স্যার পড়ানো ছেড়ে দিলে আমি যদি সিলেবাস কমপ্লিট করতে না পারি!
তখন এতটাই বোকা আর ইমম্যাচিওর ছিলাম যে এসব ভেবে ভয়েতে আমি চুপ করে গেলাম। ইনফ্যাক্ট আমায় ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হল। আর বলা হয়ে উঠল না কাউকে…
সেদিন ছোট থেকে আচমকাই কেমন বড় হয়ে গেলাম… কীভাবে কখন জানি না!