দীর্ঘদিন ধরে স্নানের জলে মানুষের রক্ত মেশানোর অভ্যাস এই রমণীর। যে কোনও মানুষ নয় যদিও। চাই বালিকা কিংবা কিশোরী মেয়েদের টাটকা রক্ত। কে যেন বলেছিল তাঁকে, অক্ষয় যৌবনের অমোঘ ওষুধ এই রক্ত।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
জলে ভরে উঠেছে বাথটাব। দেওয়ালে লাগানো আংটা থেকে ঝুলছে পাট করা নরম তোয়ালে। হাতির দাঁতের সুদৃশ্য সাইড টেবলে সাজিয়ে রাখা প্রসাধনের শৌখিন সামগ্রী। নাঃ, কোথাও কোনও ত্রুটি চোখে পড়ছে না। স্নানের সময় এখন। নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়ার এই তো সময়। কোথাও কি খুঁত রয়ে গেল কোনও? ত্বক শুকনো লাগছে না তো? ভাঁজ পড়ছে কি কোথাও? আচ্ছা, চোখের তলায় ওটা কি কালি জমেছে? আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই যেন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন মধ্যবয়সের সুন্দরী রমণীটি। মাথাভর্তি গুচ্ছ গুচ্ছ চুল ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে ওঠেন, ‘ওষুধ! ওষুধ চাই!’ বলতে বলতে চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি।
আরও শুনুন: পুলিশের ঘুম ছুটিয়েছিল কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
দৌড়ে আসে এক পরিচারিকা। কিন্তু কিছু বলার সাহস হয় না তার। অস্থির হয়ে উঠলে মালকিন যে কাউকে রেয়াত করেন না, সে কথা তারা হাড়ে হাড়ে জানে। সভয়ে পিছু ফিরে কাউকে ইশারা করে সে। এগিয়ে আসে আরেকজন। তার হাতে ধরা রয়েছে সোনার পাত্র। দ্রুত এসে বাথটাবের উপর সেই পাত্র উপুড় করে দেয় সে। আর সঙ্গে সঙ্গে… যেন জাদু! লালে লাল হয়ে ওঠে স্বচ্ছ জল। আর সেই জলের দিকে তাকিয়েই কপালের বিরক্তির ভাঁজ সমান হয়ে আসে সেই রমণীর। ঠোঁটে ফুটে ওঠে রহস্যময় হাসি। ওষুধ এসে গিয়েছে তাঁর। যে ওষুধ আজীবন ধরে রাখবে তাঁর নিটোল যৌবন। পরিচারিকাটির হাতে ধরে থাকা পাত্রের দিকে লোভীর মতো তাকান তিনি। উপুড় করা পাত্র থেকে তখনও টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়ছে তাজা লাল রক্ত। মানুষের রক্ত।
না, এই প্রথম নয়। দীর্ঘদিন ধরে স্নানের জলে মানুষের রক্ত মেশানোর অভ্যাস এই রমণীর। যে কোনও মানুষ নয় যদিও। চাই বালিকা কিংবা কিশোরী মেয়েদের টাটকা রক্ত। কে যেন বলেছিল তাঁকে, অক্ষয় যৌবনের অমোঘ ওষুধ এই রক্ত। অবশ্য তারও অনেক আগে থেকেই, রক্তের প্রতি এক অদম্য নেশা গড়ে উঠেছে তাঁর মধ্যে। বলা ভাল, তাঁর রক্তেই আছে এই নেশা। হাঙ্গেরির বিখ্যাত কাউন্ট বাথোরি পরিবারের অত্যাচারের গল্প সে অঞ্চলের কৃষকদের মুখে মুখে ফেরে। আর সেইসব অত্যাচার চোখের সামনে দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠেছেন তিনি, কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরি। তাঁর মনে পড়ে, একবার এক কৃষককে ধরে আনা হয়েছিল তাঁর বাবার সামনে। সন্দেহ করা হয়েছিল, সে গুপ্তচর হলেও হতে পারে। ব্যস। প্রমাণ-সাবুদ কিছুরই বালাই নেই, তক্ষুনি মৃত্যুপরোয়ানা জারি হয়ে গেল সেই কৃষকটির বিরুদ্ধে। তাও যেমন-তেমনভাবে মেরে ফেলা নয়। একটি মৃত ঘোড়ার পেট চিরে লোকটিকে ঢুকিয়ে তারপর সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল। আর তারপর? একইসঙ্গে গোর দেওয়া হয় জ্যান্ত লোক সমেত মৃত ঘোড়াটিকে।
আরও শুনুন: শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে নাটক ‘এক ভূতুড়ে কাণ্ড’
বংশের রক্তই বইছে তাঁর শরীরে। তাই মানুষকে অত্যাচার করে, কষ্ট দিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ পান এলিজাবেথ। কাউকে যন্ত্রণা পেতে দেখলে তাঁর শরীর জুড়ে শিহরন হয়। যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর বাছবিচার করেন না তিনি, কিন্তু তাদের কারও থেকেই এতখানি সন্তুষ্টি তিনি আজ অবধি পাননি। তাঁর আনন্দের সব উৎস যেন লুকিয়ে আছে এই পাহাড়ি দুর্গপ্রাসাদের কয়েকটা চোরাকুঠুরিতে। যেখানে প্রতিদিন তাঁর হাত থেকে যন্ত্রণার ইনাম পেতে পেতে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে অনেকগুলি কিশোরী।
কিশোরীদের উপর অত্যাচার করার এই অভ্যাসের সূত্রপাত হয়েছিল বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই। এলিজাবেথের স্বামীও ছিলেন কাউন্ট, অটোমান বিদ্রোহ দমনের জন্য তাঁকে দেশ জুড়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছিল। আর সেই সুযোগেই ফাঁকা প্রাসাদে চার বিশ্বস্ত পরিচারিকাকে নিয়ে নিজের বিকৃত উল্লাসে মাতেন কাউন্টেস। সেই সময়ে অভিজাত পরিবারের মহিলাদের কাছে মেয়েদের পাঠাত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি। উদ্দেশ্য ছিল অভিজাত আদবকায়দা শেখা। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সি এই মেয়েরাই হয়ে উঠেছিল এলিজাবেথের শিকার। তাদের গায়ে সুচ ফুটিয়ে দিতেন তিনি। ছ্যাঁকা দিতেন আগুনে পোড়ানো লোহার শলাকা দিয়ে, আর তারপরেই হয়তো তাদের ফেলে দিতেন বরফগলা জলে। এক কথায় পৈশাচিক অত্যাচারের নিত্যনতুন পদ্ধতি খুঁজে বেড়াতেন এলিজাবেথ। পাশাপাশি তাঁকে আরও নিষ্ঠুর করে তুলেছিল অনন্ত যৌবন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। একের পর এক কিশোরীকে নির্বিচারে হত্যা করে গিয়েছিলেন এলিজাবেথ বাথোরি। অথচ পরিবারের নামডাকের দৌলতে কেউ তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। অনুমান করা হয়, প্রায় ছশো মেয়েকে খুন করেছিলেন তিনি।
কিন্তু পাপ চিরদিন চাপা থাকে না। কানাঘুষো চলছিলই। একসময় গোপনে তদন্ত শুরু করলেন এক কাউন্ট। সম্পর্কে তিনি এলিজাবেথের ভাই। সৈন্যসামন্ত নিয়ে শেষমেশ এলিজাবেথের দুর্গে হানা দিলেন তিনি। আর সেখান থেকে বেরিয়ে এল সেই ভয়ংকর কাহিনি, যা এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল।
সেদিনও নিয়মমাফিক অত্যাচারের খেলায় মেতেছিলেন এলিজাবেথ বাথোরি। যন্ত্রণায় ছটফট করছিল এক কিশোরী। গায়ে একটুকরো সুতোও নেই তার। শরীরের এখানে ওখানে দগদগে ছ্যাঁকার দাগ। দাঁত বসানোর চিহ্ন। পাশবিক উল্লাসে মত্ত কাউন্টেস খেয়ালই করেননি, কখন তাঁকে ঘিরে ধরেছে খোলা তরোয়াল হাতে সৈনিকেরা। বমাল ধরা পড়েছিলেন এলিজাবেথ বাথোরি ও তাঁর সঙ্গীরা। তারপর শুরু হয়েছিল বিচার। সাক্ষ্য আর প্রমাণের পাহাড় জমছিল বিচারকের সামনে। দুর্গ থেকে উদ্ধার হয়েছিল রাশি রাশি কঙ্কাল। উদ্ধার করা হয়েছিল অনাহারে যন্ত্রণায় ধুঁকতে থাকা মৃতপ্রায় কিশোরীদের। সাধারণ মানুষের কাছে এলিজাবেথের নামই হয়ে গিয়েছিল ব্লাড কাউন্টেস।
এলিজাবেথ বাথোরির সঙ্গীদের মৃত্যুদণ্ড দিতে বিচারক দুবার ভাবেননি। কিন্তু ১৫-১৬ শতকের সেই সময়টায় অভিজাত শ্রেণির ক্ষমতা, সম্পত্তি, প্রতিপত্তি, কোনও কিছুর সীমা পরিসীমা ছিল না। সেই শ্রেণির একজন মহিলাকে তো সহজে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। তাই তাঁকে শাস্তি দেওয়ার ভার নিলেন তাঁর ভাই নিজেই। এলিজাবেথের সেই কুখ্যাত দুর্গেরই এক চোরাকুঠুরিতে তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। তারপর একটি ফোকর মাত্র অবশিষ্ট রেখে, দেওয়াল গেঁথে দেওয়া হল পুরোপুরি। সামান্য খাবার জুটত রোজ। শোয়ার জন্য সোনার পালঙ্কের বদলে বরাদ্দ হয়েছিল ঠান্ডা মেঝে। এমনকি মল-মূত্র ত্যাগ করতেও হত ওই কুঠুরিতেই। আলো বাতাসহীন, দুর্গন্ধে ভরা সেই কুঠুরিতেই জীবনের বাকি বছরগুলো থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন এলিজাবেথ বাথোরি। যে নারকীয় অত্যাচার তিনি উপহার দিয়েছিলেন ওই নিষ্পাপ কিশোরীদের, তারই একচিলতে বোধহয় নিজের জীবনে ফেরত পেয়েছিলেন ব্লাড কাউন্টেস।