যা-ই বাড়তি, তার উপরেই মানুষের কেমন যেন বাড়তি টান। পাওনাগন্ডার অধিকার সে যতই প্রখর দাবিতে বুঝে নিক না কেন, তারপরেও তার লোলুপ নজর আটকে থাকে একচিলতে ফাউয়ের পানেই। যা মিলবে কি মিলবে না সেই অনিশ্চিতির সুতোয় আটকে, প্রত্যাশার বাইরের সেই পাওয়ার আকর্ষণ উপচে ওঠে তার মনে। বছরের বাড়তি দিনে সেই বাহুল্যকেই আরেকটু বাড়তি গুরুত্ব দিলেন সরোজ দরবার।
যা বর্জন করাই সংগত, তাকে নিয়ে দু-কথা পেড়ে ফেলাই বাহুল্য। যেমন, গল্প কিংবা উপন্যাসের ভূমিকা। গুলজার তাঁর গল্প-বইয়ে লিখে দিয়েছিলেন, ‘আই হ্যাভ নাথিং টু এক্সপ্লেন অ্যাবাউট এ স্টোরি, ইফ ইট ডাজনট্ এক্সপ্লেন ইটসেলফ।’ কবি-গল্পকার সম্ভবত প্রত্যেকেই এ-কথা মর্মে মর্মে জানেন। বাহুল্য তবু সানন্দে বয়েও বেড়ান। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বললেন, ‘পাঠক যে ভার নিলে সংগত হয় লেখকের প্রতি সে ভার দেওয়া চলে না। নিজের রচনা উপলক্ষে আত্মবিশ্লেষণ শোভন হয় না। তাকে অন্যায় বলা হয় এইজন্যে যে, নিতান্ত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এ কাজ করা অসম্ভব- এইজন্য নিষ্কাম বিচারের লাইন ঠিক থাকে না।’ অতএব লেখা যে কী করে আসে, তা দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ! বললেন বটে, তবে তার পরেও প্রকাশকের প্রশ্নকে সামনে দাঁড় করিয়ে ‘নৌকাডুবি’ নিয়ে লিখে ফেললেন বেশ খানিকটা। এবং বিচারক কোথায় তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারেন, আর কোথায় তাঁর জোরের জায়গা- সে সবও চিহ্নিত করে দিলেন।
বাহুল্য এরকমই; সামান্য প্যাম্পার্ড; প্রায় পুরোটা পেরিয়ে দেরি করে সে আসে বলে তাকে ভালো না বেসে বোধহয় পারা যায় না। শিশিরকুমার দাশ নিশ্চিতই খুব শক্ত মনের মানুষ। নইলে চতুর্থ চরণের অবলুপ্তির অমন সাধনা করলেন কী করে! ৮-৬ অক্ষরবৃত্তে মিল দেওয়ার লোভ তো এসেই পড়ে। আশ্চর্য ঘোরের ভিতর তিনি তা বর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই সুধীর চক্রবর্তী বললেন, ‘তিনটি মাত্র অপ্রগলভ চরণ’ বাঙ্ময় হয়ে উঠে ধরে রেখেছে শিশিরকুমারের ‘মানস স্বাতন্ত্র্যের অভিমুখ’। অথচ বলার কথা ফুরিয়ে গেলেও কথার এক্কা নিজেই নিজেকে খানিক এগিয়ে নিয়ে যায়। সে জাড্য আটকানো যায় না। বড় মানুষরা নিজের মুখে তা স্বীকার করেন তাই বোঝা যায়। ১৮৯৫-এর ১ মার্চে লেখা একটা চিঠি এমনই বাহুল্যের হদিশ দিয়ে বলছে, “এক-একটা গান যেমন আছে যার আস্থায়ীটা বেশ, কিন্তু অন্তরাটা ফাঁকি- আস্থায়ীতেই সুরের সমস্ত বক্তব্যটা সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়াতে কেবল নিয়মের বশ হয়ে একটা অনাবশ্যক অন্তরা জুড়ে দিতে হয়। যেমন আমার সেই ‘বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে’ গানটা- তাতে সুরের কথাটা গোড়াতেই শেষ হয়ে গেছে, অথচ কবির মনের কথাটা শেষ না হওয়াতে গান যেখানে থামতে চাচ্ছে কথাকে তার চেয়ে বেশি দূর টেনে নিয়ে যাওয়া গেছে।” এই বাহুল্যটুকু বহুদিনের এপারে এসে স্বাভাবিকতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে; তবু, পুনশ্চ শোনায় খেয়াল করতে দোষ নেই।
বাহুল্য স্বাভাবিকের সঙ্গে বড় বেশি ঘনিষ্ঠ বলেই তাকে একেবারে বাজে কথা বলা যায় না। আর সে তর্ক যদি ওঠেও, রবীন্দ্রনাথই মেঘদূতের যুক্তি এমন করে সামনে আনবেন, যা প্রায় খণ্ডন করাই দুঃসাধ্য। ঋত্বিকের ছবিতে চরিত্রনিরপেক্ষ ভাবে যখন ‘হে রাম’ উচ্চারিত হয়, তা বাজে কথা না বাহুল্য! চলচ্চিত্রের শিক্ষকরা বলেন, ইতিহাসের উক্তিই সেখানে ধ্বনিত হয়, প্রক্ষিপ্ত নয়। ছোট সময় আর বড় সময়ের মধ্যে যা সেতু হয়ে থাকে, তাকে কখনও বাহুল্য বলে ভ্রম হয়। অবশ্য প্রকাশের রূপ বদলে গেলে যা স্বাভাবিক তা-ই বাহুল্য হয়ে ওঠে। রামকিঙ্কর বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন রূপ নিয়ে কাজ করেছিলেন, তখন দেখেছি, তিনি নিস্তব্ধ থাকতেন।’ অথচ শব্দ নিয়েই তাঁর আজীবনের কারবার। শঙ্খ ঘোষ আবার ছবি নিয়ে কাজ না করেও নিঃশব্দের তর্জনীকেই বেশি করে ছুঁয়ে থাকলেন। অভীক মজুমদার আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন, সম্পাদনার পরিমিতি যদি জীবনবোধে প্রকাশিত হয়, তবে তার রূপ হয়ে ওঠে শঙ্খবাবুর নৈঃশব্দ্য। শুধু লেখায় নয়, জীবনেও এই পরিমিতির কদর কিঞ্চিৎ বেশিই ছিল, সে বেশিদিন আগের কথা নয়। যতটুকু না হলে নয়, তা দিয়েই স্বচ্ছন্দে চালিয়ে নেওয়া। বাহুল্যবর্জনই ছিল তারিফের বিষয়। ক্রমে উলটপুরাণ প্রচল হল। বাহুল্যই হয়ে উঠল আত্মবিজ্ঞাপন। বৈভবের বীভৎস মূর্তি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেল; এমনকী ধার করে ঘি খাওয়াও আর অবমাননাকর রইল না; একের বদলে চারটে থাকবে কারও, কারও একটাও থাকবে না, এই যেন সময়কালের দস্তুর। বাহুল্যের এ এক বড় বিপর্যয়।
আবার বাহুল্য ভেবে বর্জনের বিপদও কম নয়। ধরা যাক, দার্শনিক বললেন, ধর্ম হল মানুষের আফিম। তার আগে নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাসের যে-কথা তিনি বলেছিলেন, এবং তার পরে, ধর্ম ও মানুষ সম্পর্কে তাঁর যে সিদ্ধান্ত, সবটাই বাহুল্য বলে কারা যেন সরিয়ে দিল! ফল হল এই যে, একটা কথার খণ্ডিত প্রকাশের ভিতর ঢুকে পড়ল সমূহ বিকৃতি। এমনধারা ব্যাখ্যা হতে থাকল যে, আস্ত দর্শনটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। আর কেউ কেউ তার রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে ভুয়ো প্রচারে ভূয়োদর্শী হয়ে ক্ষমতার ক্ষীর খেতে লাগল। বাহুল্য বর্জনের সে এক ট্র্যাজেডি কিংবা প্রহসন। যেমন, মানুষই একটা জিনিস দুচোখ মেলেই দেখতে পারে, প্রকৃতির সেরকমই বন্দোবস্ত। তবু একে যেন তার বাহুল্য মনে হয়, একচোখামি তাই ছাড়তে পারে না।
অবশ্য সচরাচর যেসব জিনিসকে আমরা বাহুল্য বলি, দেখা যাবে, আদতে তা জরুরি-ই। যেমন, ফতুয়ার বুকপকেট কিংবা গরম চায়ের ভাঁড়ের হ্যান্ডেল। দরকার পড়ে বলেই ওদের কথা মনে পড়ে। নেই বলে বাহুল্যের দুয়ো দিয়ে খানিক সান্ত্বনা পাওয়া যায়। অবশ্য এই লেখায় এই প্রসঙ্গ তেমন জরুরি হয়তো ছিল না। তবু এল, তা যে ওই এক দোষেই, সে কথা বলাই বাহুল্য।