চলে যাওয়ার এতদিন পরেও মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। আমরা যাঁকে মনে রেখেছি উত্তমকুমার নামেই। এতদিন পরেও তাঁর জন্মদিন উন্মাদনা জাগায় তাঁর ভক্তদের মনে। আর সেই সূত্র ধরেই উঠে আসে কত না গল্প! উত্তমকুমারের জন্মদিনে শুনে নেওয়া যাক তেমনই এক গল্প।
মহানায়ক বলতে আজও তাঁকেই বোঝে বাংলা সিনেমার দর্শক। আজও সেই ভুবনভোলানো হাসির মায়া কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। অথচ তিনি চলে যাওয়ার পর কেটে গিয়েছে একচল্লিশ বছর। তবু, প্রতি বছর তেসরা সেপ্টেম্বর নতুন করে জন্মান মহানায়ক। শেষ হয় না বাঙালির উত্তম যাপন।
আরও শুনুন: ‘মানিকমামা’-র ছবিতে গান গেয়ে পারিশ্রমিক নিতেন না কিশোর কুমার
আসলে উত্তমকুমার তো কেবল ‘স্টার’ ছিলেন না, অসামান্য অভিনেতা ছিলেন না, মানুষ হিসেবেও যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। যাঁরা তাঁর সঙ্গ পেয়েছেন কখনও না কখনও, সকলে একবাক্যে স্বীকার করেন একথা। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার আরেক বিখ্যাত নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়।
অনিল চট্টোপাধ্যায় তখন সদ্য পা রেখেছেন টালিগঞ্জের রুপোলি জগতে। ঘটনাচক্রে সুযোগ এল উত্তমকুমারের সঙ্গে একই ছবিতে অভিনয়ের। উত্তমকুমার ততদিনে বাংলা ছবির অবিসংবাদিত নায়ক। কিন্তু তারকাসুলভ হাবভাব দিয়ে নতুন অভিনেতাটিকে দূরে সরিয়ে রাখেননি তিনি। একদিন শুটিং চলছে, লাঞ্চব্রেকে অনিলকে ডেকে নিলেন উত্তমকুমার। একসঙ্গে লাঞ্চ করবেন দুজনে। গোলমালটা বাধল এরপরেই। উত্তমকুমার সাধারণত আলাদাই লাঞ্চ করতেন। তাই তিনি জানতেন না যে তাঁর প্রিয় সিনেমাপাড়া খাবারের মধ্যেও কেমন ভেদাভেদ তৈরি করে রেখেছে। কতখানি অসম্মান সেখানে লুকিয়ে থাকে সাধারণ অভিনেতাদের জন্য! সেদিন দেখলেন তাঁর জন্য খাবার এল রোজকার মতোই। দামি প্লেটে সাজানো সুখাদ্য। আর তাঁর পাশে বসা নবাগত অভিনেতার জন্য বরাদ্দ শালপাতার থালা। তাতে সাধারণ ভাত ডাল।
আরও শুনুন: ‘নতুন স্ক্রিপ্টটা কতদূর?’, এখনও ঋতুপর্ণের চিত্রনাট্য শোনার অপেক্ষায় ‘দোসর’ প্রসেনজিৎ
আসলে, এটাই ছিল তখন টলিপাড়ার অলিখিত নিয়ম। খাবার দেওয়া হত আর্টিস্টদের গ্রেড মেপে। যাঁরা নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রী, তারকা, তাঁদের জন্য দামি মেনু। আলাদা ব্যবস্থা। আর বাদবাকি অভিনেতা অভিনেত্রী, শিল্পী, কলাকুশলীদের জন্য বারোয়ারি ব্যবস্থা। বহুদিন ধরেই এই নিয়ম চলে আসছিল। কিন্তু সেদিন এককথায় সেই নিয়ম ভেঙে দিলেন টলিপাড়ার মহানায়ক উত্তমকুমার। চিৎকার করে ডাকলেন প্রোডিউসারকে। তারপরের ঘটনা সম্পর্কে জানাচ্ছেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, প্রযোজকের সামনে নিজের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন উত্তমকুমার। রাগে থমথম করছে তাঁর মুখ। সাফ জানালেন, যেদিন এই কদর্য বিভাজন বন্ধ হবে, সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের জন্য একইরকম খাবারের ব্যবস্থা করা হবে, তার আগে এখানে খাওয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। যদিও নিজের আত্মজীবনী ‘আমার আমি’-তে প্লেট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়েছেন উত্তমকুমার। বলেছেন, সেদিন প্লেট সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। হয়তো সৌজন্যের খাতিরেই। সে যাই হোক, সেদিনের ঘটনার দৌলতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই বিভাজন। আর সিনেমার পর্দা শুধু নয়, সিনেমাপাড়ার মানুষের মনেও চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল মহানায়কের আসন।