শরণার্থী সংকটের কাঠামো ধরে আদতে তাই রাজকুমার-শাহরুখ বলতে চেয়েছেন মানুষের গল্প, মানবিকতার গল্প। দেশ শুধু সীমান্তের বাঁটোয়ারায় রাখা নেই। তা আছে মানুষের পাশে মানুষ থাকে বলেই। একদিন রাজনীতি এসে একদল মানুষকে শরণার্থী করে তোলে। কখনও আবার জীবনের বঞ্চনা আর ভালো জীবনের মায়াহরিণ কাউকে শরণার্থীর পরিচয় দেয়। ‘ডাঙ্কি’ ছবিতে উঠে এল সেই সংকটের গল্পই, দেখলেন সরোজ দরবার।
ভালোবাসা আসলে এক বিশল্যকরণী বৃক্ষ। ভালোবাসা এক সুতীব্র আনচান। ভালোবাসা-ই মাতৃভূমি। যে-ছায়াতে তোলা থাকে উপশম ও আরোগ্য। স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা। ভালোবাসাহীন বেঁচে থাকা যেন শরণার্থী জীবনের মতোই। মানুষ তাই ফিরতে চায় আপন ভূমিতে, ভালোবাসার কাছে। বিপর্যয় আর দুর্ভাগ্যের দেশান্তরে বসে ক্লান্ত মানুষ শুধু বলতে চায়, এ পরবাসে রবে কে!
এই পরবাসের ব্যাপ্তি নানা ভাবেই এসেছে রাজকুমার হিরানির ডাঙ্কি-তে। দর্শক জানেন, তাঁর পরিচালনার ঘরানা। কমেডির হালকা ছোঁয়ায় জীবনের গূঢ় থেকে গূঢ়তর মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া তাঁর সিগনেচার। এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। গল্পের কাঠামো হিসাবে তিনি তুলে নিয়েছেন শরণার্থী সংকটকে। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের রাজনীতিতেই যা এক দগদগে ক্ষত। একদিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। অন্যদিকে সেই দেশছাড়া মানুষদের নিয়ে চলছে দেদার পণ্যসভ্যতা কিংবা অসভ্যতা। মানুষের হাতে মানুষই পণ্য। সে পাচার হচ্ছে। মরে যাচ্ছে। মরতে মরতে কোনওক্রমে হয়তো বেঁচেও যাচ্ছে। শুধু গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে তার পরিচিতি, সত্তা, ভালোবাসা। সমাজতাত্ত্বিকরা নিশ্চিতই ধরিয়ে দেবেন যে, এই শরণার্থী সংকটকে পুঁজি করে কেমন ভাবে গোটা বিশ্বেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। শরণার্থীদের দুর্ভাগ্যকে মূলধন করে কীভাবে ঘৃণার বীজ বপন করা হচ্ছে দেশে দেশে, এবং সেই বিদ্বেষই হয়ে উঠছে রাজনীতির অন্যতম বর্ম; এ সব আমাদের অজানা নয়। এমনকী আমাদের দেশেও, হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাধ্যমে ঘৃণার যে প্রচার, তারও একটা বড় অংশ জুড়ে শরণার্থীরাই, স্থানবিশেষে শুধু নাম বদলে যায় মাত্র। ঠিক এই রাজনৈতিক আবহের ভিতর বসেই রাজকুমার হিরানি যে শরণার্থী সমস্যাকেই, আরও স্পষ্ট করে বললে বেআইনি অভিবাসনকেই তাঁর সিনেমার বিষয় করে নিয়েছেন, তা নেহাত কাকতালীয় নয়। বরং সচেতন এবং সুচিন্তিত ভাবনা। আর সে ছবিতে শাহরুখ খানের থাকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আগের ছবি ‘জওয়ান’-এ দেশ এবং দেশের ধারণা নিয়ে মোটা দাগে হলেও বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। এবারের পথ অন্য। বেশ সূক্ষ্ম, যেন প্রায় অনুচ্চারেই এবার তিনি সেই দেশের কথাই বললেন। বললেন, আরও ব্যাপ্ত প্রেক্ষিতে। তবে তা বলিউডের ইমোশনাল ড্রামার ছাঁচ ভেঙে নয়, এমনকী রাজকুমার হিরানির সিগনেচার স্টাইল ভেঙেও নয়। বরং নিজের স্টাইলই ভেঙে ফেলেছেন শাহরুখ। সিনেমার সাম্রাজ্যে কর্তৃত্ববাদী সুপারস্টারের বদলে তিনি আপ্রাণ হয়ে উঠেছেন রাজকুমার হিরানির প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে একজন। আর সেই চরিত্র বলে, ঘরে ফেরার কথা। ভালোবাসার মানুষের কাছে ফেরার কথা।
আরও শুনুন: ‘মন্নত’ থেকে প্রযোজনা সংস্থার মালকিন, গৌরী খানের মোট সম্পত্তির পরিমাণ কত?
এ ছবি যেন এক অর্থে, একজন সুপারস্টারেরও ঘরে ফেরা। সেই নয়ের দশকের মাঝামঝি থেকে শুরু করে হিন্দি সিনেমা যেভাবে নানা চরিত্রে শাহরুখ খান এনিগমা নির্মাণ করেছে তার একটা গড় বিশেষত্ব ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সব চরিত্ররা বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠ, যদিও দেশের মূল্যবোধ ভোলেনি। যে সিনেমা থেকে শাহরুখের রোম্যান্টিক হিরোর জার্নি শুরু হল বলা যায়, সেই ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ থেকে শুরু করে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ‘কভি খুশি কভি গম’ কিংবা ‘পরদেশ’ বা ‘কাল হো না হো’- মোটামুটি সর্বত্রই তিনি একই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। উদার অর্থনীতির সেই দিনকাল দেশকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, দেশের ভিতরই খুলে দিয়েছিল যে সব আগল, তাতে শাহরুখ অভিনীত পর্দার চরিত্ররা হয়ে উঠেছিল চরিত্রের অধিক। আসলে হয়ে উঠেছিল দেশবাসীর স্বপ্নেরই অনুবাদ। লিবারেলাইজেশন পরবর্তী যুগে ভারতবর্ষ তাই যেন পেয়ে গিয়েছিল দুই সুপারস্টারকে। ক্রিকেটে শচীন তেন্ডুলকর, আর রূপোলি পর্দায় শাহরুখ খান। ভালোবাসার এক গোপন সিন্দুক তাই তাঁর জন্য তোলা থাকে বরাবর। ‘ডাঙ্কি’ যেন সেই আড়াই দশকের শাহরুখ-নির্মাণের এক পালটা বয়ান। এখানেও তিনি স্টার বটে, তবে সেই স্টার, যিনি সন্ধ্যাতারা দেশের আকাশেই।
আসলে যে স্বপ্ন শাহরুখের চরিত্ররা বিলি করত পর্দার ওপার থেকে, তারই অন্ধকার দিকে থেকে যায় ‘ডাঙ্কি’ সিনেমার বল্লি (অনিল গ্রোভার), বুগগু (বিক্রম কোছর),মনুরা (তাপসী পন্নু)। দেশের অর্থনীতি তাদের সাধ পূরণ করতে দেয়নি, দেয়নি সম্মানের জীবন। জীবনের সেই মার খেতে খেতে, আর একটু ভালো জীবনের প্রত্যাশায় তাই তারা স্বপ্ন দেখেছে সীমান্তপারের জীবনের। কাকতালীয় নয় যে, যখন তারা এই স্বপ্ন দেখছে, সেই ১৯৯৫-এই দেশে মুক্তি পাচ্ছে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’। অন্ধকার সিনেমাহলের আলোকোজ্জ্বল পর্দায় স্বপ্নের সওদাগর এসে প্রেমের ময়ূরপঙ্খীতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কাছের মানুষকে। ঠিক একই সময়ে, দূর দেশে বিয়ে হওয়া যাওয়া পাঞ্জাবে প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও এক জসসির কাছে, স্বামীর অত্যাচারে মার খেয়ে মরতে বসা জসসির কাছে পৌঁছতে পারে না সে গ্রামেরই যুবক সুখী (ভিকি কৌশল)। স্বপ্নের ভিসা লাগে না ঠিকই, লাগে মানুষের। রাজনীতির ভাগ-বাঁটোয়ারা এমনই বন্দোবস্ত করেছে মানুষের পৃথিবীর জন্য। ফলত, সুখীরা ভিসা পায় না। কেননা ইংরেজি তাদের আয়ত্ত নয়। সুখী, জসসির জীবন বিপর্যস্ত হয়। আর সেই বিপর্যয়ের ছাই হাতে নিয়ে ডাঙ্কি রুটের বেআইনি বিপদসংকুল বিদেশযাত্রায় পাড়ি দেয় মনু, বগগুরা। এ এক রকমের ট্র্যাজেডিই বটে। আর সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শাহরুখের হার্ডি সিং চরিত্রটি। সিনেমার আভাস অনুযায়ী এক সময় সে সৈনিক ছিল। জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা জানাতে পাঠানকোট থেকে এসেছিল পাঞ্জাবের গ্রামে। আর ফেরা হয়নি। আসলে ফেরার দরকার হয়নি। কেননা এখানেই ছিল সেই ভালোবাসার বিশল্যকরণী। হার্ডি সিং চাইলেই বিদেশে থেকে যেতে পারত। দেশের নিন্দা করে বেছে নিতে পারত পরদেশের আশ্রয়। বিশেষত প্রেমের জোড়টিও যখন সেখানে বাঁধা সম্ভব ছিল, তখন অন্যথা হওয়ার যেন উপায়ই ছিল না। তবু ব্যতিক্রম হার্ডি সিং। পর্দার রাজ, রাহুলরা সহজেই বিদেশে নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারে। আর, বাস্তবের বুগগু, মনুরা স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করে হাতে পায় অবাঞ্ছিত হয়ে বিদেশে থাকার নিয়তি। মাঝখানে যেন হাইফেন হয়ে থাকে হার্ডি। দেশের বদনাম করে সে অন্য দেশে থাকতে রাজি নয়। বরং বিদেশের আদালতে দাঁড়িয়ে বারবার বলতে থাকে, বাধ্য না হলে কে আর নিজের দেশ ছেড়ে আসে! তাহলে কেন এত আইনকানুন! যা মানুষকে মানুষ হিসাবেই স্বীকৃতি দেয় না! রাশিয়ার পাখি পাঞ্জাবে গেলে তো তাকে ফিরে যেতে হয় না! পাখিদের সেই ভাষা মানুষ বোঝে না কেন! এ প্রশ্নের উত্তর স্বভাবতই ছিল না আইনের রক্ষকদের কাছে। থাকার কথাও নয়। তবু এই হার্ডি সিং যেন নিজের কথা নয়, গোটা বিশ্বের কথাই বলতে থাকে। দেশে দেশে এখন শরণার্থীর ঢল। কখনও রাজনৈতিক সংকটে, কখনও আবার এমনই ভালো জীবনের তাড়নায় উন্নত দেশগুলির দরজায় মাথা ঠুকছে মানুষ। আর সেই নিয়ে চলছে দেদার মানুষ-ব্যবসা। হার্ডি সিং প্রকারান্তরে তাঁদের কথাই বলে, যাঁরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর হয়ে ওঠেন। হয় গ্রেপ্তার হয়ে, নয় বুলেটে বিক্ষত হয়ে।
শরণার্থী সংকটের কাঠামো ধরে আদতে তাই রাজকুমার-শাহরুখ বলতে চেয়েছেন মানুষের গল্প, মানবিকতার গল্প। দেশ শুধু সীমান্তের বাঁটোয়ারায় রাখা নেই। তা আছে মানুষের পাশে মানুষ থাকে বলেই। একদিন রাজনীতি এসে একদল মানুষকে শরণার্থী করে তোলে। কখনও আবার জীবনের বঞ্চনা আর ভালো জীবনের মায়াহরিণ কাউকে দেয় শরণার্থীর পরিচয়। তবে, সে সব পেরিয়ে মানুষের পরিচয় কি শুধুই মানুষ হতে পারে না! ছবির উত্তরণ ঘটে, যখন বৈশ্বিক এই সংকটকে ব্যক্তির সঙ্গে মিশিয়ে দেন পরিচালক। শুধু বেআইনি বিদেশযাত্রীই তো ডাঙ্কি নয়, ডাঙ্কি সে, যে আপনজনের থেকে দূরে থাকে। ভালোবাসার কাছেই তাই ফিরতে চায় মানুষ। একমাত্র সেই গন্তব্যেই টানা যায় ইতিচিহ্ন। ছোট ছোট বিভেদের ফাঁদে পা দিয়ে আমরা যখন ভালোবাসাকেই অকিঞ্চিৎ করে তুলি, তখন হয়তো মনে পড়বে যে, ভালোবাসার জন্য আর্তি আসলে শরণার্থী জীবনের মতোই। শরণার্থীদের নিয়ে যখন বিদ্বেষ উসকে দেওয়া হবে আমাদেরই ভিতরে, তখন হয়তো মনে পড়বে যে, শরণার্থী কেউ সাধ করে হতে চায় না। নিয়তিনির্দিষ্ট এক পরিস্থিতিই তাকে সেই বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। তাহলে কীসের জন্য এত ভেদাভেদ? কেনই বা ‘প্রেমেরে বিদায় করে দেশান্তরে’ বেলা যাবে! ‘ডাঙ্কি’ খানিক হাসায়, খানিক কাঁদায়, তবে শেষমেশ এ-ছবি বিশ্বের মানুষের কাছেই যেন একটা কথাই বলতে চায়-
‘সমস্ত পৃথিবী এক দেশ করো,
সমস্ত পৃথিবী
মানুষের মাতৃভূমি করো।
…
সমস্ত পৃথিবী এক দেশ করো; যদি মানুষের জন্য
সামান্য করুণা থাকে বুকে।’ (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)