আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, পরিবারের গণ্ডি ঠিক করে দেন, পিতৃপুরুষ। তা সে পিতা কড়া রোদেলা হোন, আদুরে মেঘলা বা কখনও পানসে পাষাণই হোন না কেন। আর সেই সমকালীন সমাজেরই ছবি ভেসে আসে সিনেমার পর্দায়। নানা চরিত্রের অধিকারী সিনেমার সেই বাবাদের নিয়েই আজ কথা হোক বরং।
সিনেমাতে যেমন বৃহত্তর সমাজের গল্প উঠে আসে, কখনও কখনও ক্ষুদ্র পরিসরের সমকালীন পারিবারিক গল্পও থাকে। আর সিনেমার বিশেষ চরিত্রদের গড়ে ওঠা অনেকটাই ঠিক করে দেন ‘বাবা’ চরিত্রেরা। সেই চরিত্রগুলো ঠিক আমার আপনার বাবাদের মতোই।
আরও শুনুন: কার্ড বা ফুলের উৎসব নয়, ফাদার্স ডে’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে মর্মান্তিক শোকের ঘটনা! জানেন কী?
হাল আমলের ‘মিমি’ সিনেমাটা মনে পড়ছে? মেয়ে বিড়ি খায় জেনে, তাঁকে কী বললেন বাবা পঙ্কজ কাপুর? না, সাতসকালবেলা নিজের পকেট হাতড়ে বিড়ি না পেয়ে, মেয়ের কাছে চললেন ধার চাইতে। সিনেমায় এমন ছকভাঙা ‘বাবা’ চরিত্ররাও আছেন, যাঁরা কখনও কখনও রান্নাবান্না – ঘরকন্নার বদলে, মেয়েদের জাতীয় কুস্তিগির বানানোর লক্ষ্য নিয়ে কসরত করিয়ে করিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন। ‘দঙ্গল’ সিনেমায় আমির খানের চরিত্রটা যেমন। আবার বাবা মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের মাথার উপর একাই ছাতা মেলে ধরতে দেখা গিয়েছে কোনও সিঙ্গল ফাদারকেও। ‘দ্য শেফ’ ছবিতে যেমন আমরা দেখেছি, স্কুলের ছুটিতে বাবার কাছে থেকে রান্না শেখার অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযুদ্ধের অনেক বাধা কাটিয়ে উঠতে শিখছে সন্তানও।
কিন্তু যে সন্তানরা বেকার, অলস এবং জেদি? তেমন সন্তানের বেলায় কড়া হাতে রাশ ধরতেও জানেন অনেক বাবা। তেমনটাই আমরা দেখেছি ‘ওয়েক আপ সিড’ ছবিতে। যেখানে ছেলেকে ঘর থেকে তাড়িয়েই দেন বাবা। এই সন্তানদের সামনে আসলে দুটো পথ খুলে দেন তাঁরা। এক, ছেলে পরিস্থিতির চাপে একদিন ঠিক স্বাবলম্বী হয়ে যাবে, আর না হলে বাবার শর্ত মেনে নেবে মাথা নিচু করে। তবে সিনেমার বেশিরভাগ বাবা-ই চান যে তাঁদের সন্তানরা জিতে যাক, স্বাবলম্বী হোক। ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’-তে রাজের বাবাও তাই চেয়েছিলেন। আমরা শুধু এতকাল সিমরনের বাবার সেই কালজয়ী ডায়লগই মনে রেখেছি, ‘যা সিমরন যা, জি লে আপনি জিন্দেগি’। একই সময়ে দাঁড়িয়ে রাজের বাবা অনুপম খেরও কিন্তু বলেছিলেন, ছেলে যা চায়, যাকে চায়, তাকে না নিয়ে যেন সে বাড়ি না ফেরে। নিজের সবটুকু দিয়ে সন্তানের ইচ্ছেপূরণের চেষ্টা করেন, ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এর ‘ঘাসিটেরাম’ ওরফে ইরফান খানও। আবার একজন বাবা হিসেবে, পরিবারের কর্তা হিসেবে, সন্তানদের জন্য, পরিবারের জন্য খুন করতে এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হওয়া সমস্ত ঝুঁকি সামলাতেও যে বাবারা পিছপা হন না, তা আমাদের শিখিয়েছে ‘দৃশ্যম’ সিনেমার অজয় দেবগণের চরিত্র ‘বিজয় সালগাওকর’।
আরও শুনুন: ঋতুকালে মাকে ‘রানির হালে’ রাখেন, বাবা-ছেলের ট্যাবু ভাঙার উদ্যোগে আপ্লুত নেটদুনিয়া
কেবল বাবা আর ছেলের কথাই তো হল এতক্ষণ। ছেলের মধ্যে দিয়ে বাবা নিজেকেই দেখতে চান একবারে ত্রুটিহীন রূপে, এ কথা তো জানাই। কিন্তু বাবা আর মেয়ের সম্পর্ক? এখানে মনে করে নেওয়া যাক অমিতাভ বচ্চনকে। দুটি ভিন্ন সিনেমায় তাঁর মাধ্যমে বাবা-মেয়ের সম্পর্কের ওঠা-পড়া দেখেছি আমরা। মহাব্বতে সিনেমায় ওভারপ্রোটেকটিভ বাবা নারায়ণ শঙ্কর, সন্তানকে হারিয়ে কেমন পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। একটু একটু করে তাঁকে সেই পাষাণ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনে তাঁর মৃত মেয়ের প্রেমিক। পাশাপাশি উঠতে পারে ‘পিকু’ সিনেমার কথা। যেখানে, বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়া মেয়ের বিয়ের কথা উঠলেই তাঁর বৃদ্ধ বাবা বলে ওঠেন, ছোটবেলায় আমি তোমার দেখাশোনা করেছি। এখন আমার বয়স হয়েছে, এখন আমি নিজে নিজে সব পারি না, তাহলে এখন তোমার দায়িত্ব আমার দেখাশোনা করা। বয়সকালে বাবারা যে সত্যিই সন্তানদের মধ্যে অবলম্বন খোঁজেন, সে কথাই স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দেন তিনি।
বাবারা আমাদের ছোটবেলার প্রথম সুপারহিরো। বাবারা বাঁচতে শেখান। দেন জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে হাতেখড়ি। শেষবেলায় বলব তেমনই একটি সিনেমার কথা। ১০২ বছরেও দত্তাত্রেয় ভাখারিয়ার চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন, তাঁর ৭৫ বছরের ছেলেকে শিখিয়েছেন কীভাবে চাপমুক্ত জীবন কাটানো যায়। সত্যিকারের জীবনেও বাবারা তো এমনভাবেই আমাদের ঘিরে থাকেন। আর আমরা বড় হয়ে উঠি তাঁদের ভবিষ্যতের সঞ্চয়ে, তাঁদের গিলে নেওয়া কান্নায়, তাঁদের শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়াল আর জীর্ণ কামিজে।