বিভেদ-বিদ্বেষ পেরিয়ে গোটা দেশের অসংখ্যা সাধারণ মানুষ যেভাবে শাহরুখের জন্য এক হলেন, তা স্রেফ নায়কের প্রত্যাবর্তন নয়। বরং যে দেশ হারিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের খেদ, সেই দেশকেই যেন নতুন করে খুঁজে পাওয়া। সিনেমার যুক্তি-তক্কো পেরিয়ে ঠিক এখানেই জিতে যায় ‘পাঠান’। জিতে যান অসংখ্য সাধারণ মানুষ আর তাঁদের ভালোবাসার নায়ক- শাহরুখ খান।
সে ছিল একটা সময়। শাহরুখ খান আর ভারতবর্ষকে আলাদা করে কল্পনা করাই কষ্টসাধ্য ছিল। তারপর ভারতবর্ষ গেল বদলে। আরিয়ান খান তখন ড্রাগ রাখার অভিযোগে ধরা পড়েছেন। সে অভিযোগ ঠিক কি ভুল, সে তো অনেক পরের কথা। তার ফয়সলা করেছে দেশের বিচারব্যবস্থা। কিন্তু ঘটনা হল, শাহরুখ খান নামের একটা পৃথিবীই যেন ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল সেই ঘটনার অভিঘাতে। সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমে তাই যখন বলা হল, শাহরুখ খানের ভারতবর্ষ বদলে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে, তখন অনেকেই আক্ষেপ করেছিলেন। হ্যাঁ এটা ঘটনা যে ভারতবর্ষ বদলেছে। সে বদল হয়তো স্বাভাবিকই। তবে তা কতটা ভাল বা মন্দ, তা তর্কযোগ্য বিষয়। তবে এই বদলের ভিতরও যে সত্যি শেষ পর্যন্ত মোছা সম্ভব হল না, তা হল শাহরুখ খানের পৃথিবী ভেঙে পড়েনি। বরং নতুন সময়ে, নতুন পৃথিবী গড়ে নিয়েছেন শাহরুখ। পুরনো সেই ড্রাগের ইতিহাস এখন অতীত, বরং শাহরুখ নামের নেশার কাছেই নতুন করে ফিরে এসেছেন ভারতবাসী। ‘পাঠান’ তাই সিনেমা হিসাবে কতটা ভাল-মন্দ, সে বিচার তাত্ত্বিকরা করবেন; তবে সে সব পেরিয়ে বলা যায় অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষের আবহ মুছে দিয়ে, স্রেফ ভালোবাসায় যে সবাইকে জুড়ে ফেলা যায়, তা আর একবার করে দেখিয়েছেন শাহরুখ। পর্দায় এ যেন তার অন্যরকম এক ভারত-জোড়ো যাত্রা।
আরও শুনুন: ফ্যানের কীর্তি! মৃত্যুর আগে ৭২ কোটি টাকার সম্পত্তি সঞ্জয় দত্তের নামে উইল মহিলার
দর্শকরা, বলা ভাল ফ্যানরা মনে রাখতে চান না; কিন্তু সাল-তারিখের হিসাব বলছে শাহরুখের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। এই বয়সে ক-জন অভিনেতা সম্পূর্ণ ভোল বদলে, এমন একটা স্টাড লুকে পর্দায় আসার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস পাবেন? কিন্তু তিনি যে বলিউডের বেতাজ বাদশা, আর না জানি কত লক্ষ কোটি মনেরও! তাই পারলে তিনিই পারেন। লক্ষকোটি মানুষের মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁকে হারতে দেয় না। ‘শাহরুখ খান অ্যাজ পাঠান’ – স্ক্রিনে এই লেখাটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাই সিনেমা হল হাততালি-সিটি-চিৎকারে ফেটে পড়ে। এই বয়সে এসেও তাই তিনিই সেই ‘স্টাড পাঠান’। অনেকেই বলবেন, শাহরুখের বেয়ার লুক তো এর আগেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু এই সিনেমায় তো তাঁর জন আব্রাহামের সঙ্গে পাল্লা। অতএব টক্করটা একেবারে সেয়ানে সেয়ানে। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়! তবে আসলে যে তিনি রোম্যান্সের বাদশা তাও বুঝিয়ে দেন সিনেমার প্রতি পদে। তাই অফিশিয়াল মিশনে থেকেও, পাঠান মস্তিষ্ককে নয়, বরং প্রায়োরিটি দেন মনকে, মানে এগিয়ে রাখে এই আর কি। আর তাতে যা হওয়ার তাই-ই হয়! প্রেমের কাছে প্রতারিত হয়ে বমাল গ্রেপ্তার, অন্ধকার সেল, আর অজস্র নানাবিধ অত্যাচার সহ্য করার পরও, শাহরুখ সেই শাহরুখেই। কারণ তিনিই তো শিখিয়েছেন আমাদের ভালবাসতে। তিনিই শিখিয়েছেন প্রেম একবারই হয়। তিনিই শিখিয়েছেন তুমি যাকে ভালবাসো, সেও তোমাকেই ভালবাসবে এমন কোনও রুল তো নেই! এহেন রোম্যান্টিক হিরো এবার একটি আদ্যন্ত অ্যাকশন মুভিতে। তিনি শুধু দু-হাত বাড়িয়ে দিলেই হাততালিতে ভেসে যায় হল। অ্যাবস দেখিয়ে সিটি আর হাততালি তিনি এর আগেও কুড়িয়েছেন। তাহলে বাকি থাকল কি? না পাঠান। সিনেমার মতোই সে সবার সঙ্গে মিশে, সবার হয়ে থাকতে চায়। এই থাকাটাই তো বাস্তবের শাহরুখ খান। সমস্ত বিতর্ক, শ্লেষ, ব্যঙ্গোক্তি, ট্রোলের ঊর্ধ্বে যিনি সবাইকে আপন করে নিতে জানেন। জুড়ে দিতে পারেন আসমুদ্র হিমাচল।
আরও শুনুন: মাসে কত উপার্জন করেন? ফ্যানের প্রশ্নে প্রকাশ্যে সত্যিটা বলেই দিলেন শাহরুখ
পাঠান নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। বয়কটের ধোঁয়ায় ঢেকেছিল নেটদুনিয়ার আকাশ। বিক্ষোভ হয়েছে। সেন্সরের কাঁচি চলেছে ছবির শরীরে। এমনকী রাজনৈতিক হই-হট্টগোলও হয়েছে বিস্তর। তবু শেষমেশ ‘কে শাহরুখ?’ থেকে ‘শ্রী শাহরুখ’-এ এসে পৌঁছেছেন নেতা। আর ভেঙে-পড়া পৃথিবী থেকে জুড়ে-থাকা পৃথিবীর দিকে এগিয়েছেন শাহরুখ। যে দেশে অসহিষ্ণুতার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে বলছে আক্ষেপ করেন অনেকে, যে দেশের বাতাস থেকে ঘৃণার বিষবাষ্প দূর করতে ভালবাসার ফেরিওয়ালা হয়ে পথে নেমেছেন রাজনৈতিক নেতা, সে-দেশে শাহরুখের ফিরে আসা বেশ অন্যরকম এক বার্তাই। হ্যাঁ, সিনেমার গল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। খুঁত-খামতি নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু বিভেদ-বিদ্বেষ পেরিয়ে গোটা দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষ যেভাবে শাহরুখের জন্য এক হলেন, তা স্রেফ সিনেমার নায়কের প্রত্যাবর্তন নয়। বরং যে দেশ হারিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের খেদ, সেই দেশকেই যেন নতুন করে খুঁজে পাওয়া। সিনেমার যুক্তি-তক্কো পেরিয়ে ঠিক এখানেই জিতে যায় ‘পাঠান’। জিতে যান অসংখ্য সাধারণ মানুষ আর তাঁদের ভালোবাসার নায়ক- শাহরুখ খান।