ধনীর বিলাসী গাড়িতে যেমন এখনও বেজে ওঠে তাঁর গান, তেমনই ছাপোষা অটোও ভেসে যায় তাঁর সুরের ঢেউয়ে। কিশোরের গানের এমনই বিস্তার। এমনই বিস্তীর্ণ আবেদন। প্রকৃত শিল্পী বলেই বোধহয় তিনি ঘুচিয়ে দিতে পারেন সব বিভেদ। সহজিয়া সুরের সাধনায় কিশোর কুমার যেন সেই অলৌকিক ফকির, যাঁর সংগীত ঐশ্বর্যে ধনী হয়েছে যুগের পর যুগ। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
‘এক অজনবি হাসিনা সে’ গাইতে গাইতে রবীন্দ্র সরোবরের গেট পেরোচ্ছে সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা এক পড়ুয়া। ঠিক তখনই পাশের এক চা দোকানে কেউ গুনগুন করে উঠলেন, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোয়ি…’। সন্ধে-সন্ধে অফিস থেকে বেরিয়ে কেউ হয়তো আপন মনেই গেয়ে উঠলেন ‘ইয়ে সাম মস্তানি’। গান থেকে গানে গড়িয়ে যায় জীবনের কথা। আর গানের বাঁধনে বাঁধা পড়ে যায় বহু বহু মানুষ। নাহ্ একটু বোধহয় ভুল বলা হল। স্পষ্ট করে বলতে গেলে আসলে বলতে হয়, বহুকালের বহু মানুষকে যেন বাঁধা পড়ে আছে কিশোর কুমারের গানে।
আরও শুনুন: সলিল চৌধুরীর গান গাইতে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন কিশোর কুমার, কেন জানেন?
আসলে কিশোর কুমার মানেই এক অমোঘ ইন্দ্রজাল। এমন এক ম্যাজিক যার হিসেবনিকেশ হয় না। যার বিচার হয় না সুরের কালোয়াতিতে। বরং মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে কিশোর কুমার যেন হয়ে উঠেছেন কালের কণ্ঠ। মানুষের হর্ষ-বিষাদে, মিলন-বিরহে তাঁর গান অমরসঙ্গী। ধনীর বিলাসী গাড়িতে যেমন এখনও বেজে ওঠে তাঁর গান, তেমনই ছাপোষা অটোও ভেসে যায় তাঁর সুরের ঢেউয়ে। কিশোরের গানের এমনই বিস্তার। এমনই বিস্তীর্ণ আবেদন। প্রকৃত শিল্পী বলেই বোধহয় তিনি ঘুচিয়ে দিতে পারেন সব বিভেদ। সহজিয়া সুরের সাধনায় কিশোর কুমার যেন সেই অলৌকিক ফকির, যাঁর সংগীত ঐশ্বর্যে ধনী হয়েছে যুগের পর যুগ।
আরও শুনুন: ‘মানিকমামা’-র ছবিতে গান গেয়ে পারিশ্রমিক নিতেন না কিশোর কুমার
এই কণ্ঠকেও একদিন স্তব্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। দেশ জুড়ে তখন নেমে এসেছে অস্থির এক অরাজকতা। সময়টা ১৯৭৬ সাল। জরুরি অবস্থার বিষবাষ্পে তখন হাঁসফাঁস করছে দেশের গণতান্ত্রিক আত্মাটি। দেশের শিল্প-সংস্কৃতির উপর নেমে আসছে শাসকের চাবুক। এহেন পরিস্থিতিতে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন সরকারের প্রচার জরুরি। আর সেখানে চাই এমন এক কণ্ঠ, যা সকলের প্রিয়। সর্বমান্য বা সর্বজনগ্রাহ্য শুধু নয়, যা সকলের আদরের। সেই কণ্ঠই বলে যাবে সরকারের কথাগুলো, যা দেশের সমস্ত মানুষের মন জয় করে নেবে এক লহমায়। আর সেক্ষেত্রে প্রথমেই উঠে আসে কিশোর কুমারের নাম। কিশোর কণ্ঠেই সেদিন সরকার তার মতামত প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু শাসকের হাতের সুতোয় শিল্পী কেন বাঁধা পড়বেন! অতএব সে প্রস্তাবে রাজি হননি কিশোর কুমার। বিপদে পড়তে পারেন জেনেও একবারেই নাকচ করে দিয়েছিলেন সরকারের প্রস্তাব। প্রত্যাশিত ভাবেই নেমে এল আঘাত। সমস্ত সরকারি গণমাধ্যমে কিশোর কুমারের গানে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। জরুরি অবস্থার সময়টা, মানুষ দুরদর্শন কিংবা আকাশবাণীতে কিশোর কুমারের গান শুনতে পেতেন না। আর তখনকার দিনে এত বেশি বেসরকারি চ্যানেলের রমরমা ছিল না। বিনোদনের একমাত্র ভরসা ছিল ওই সরকারি গণমাধ্যমগুলোই। সেখান থেকে কিশোরের সুর মুছে যাওয়ায় অনেকেই ভেবেছিলেন আর নতুন করে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারবেন না তিনি। নাহ্ শাসকের সেই আশা সফল হয়নি। কেননা মানুষতা যে কিশোরকুমার! যাঁর কণ্ঠের দরদ স্পর্শ করেছে দেশবাসীর মর্ম, শাসকের বর্ম তাঁকে কি মুছে দিতে পারে! পারেনি। বরং কালের নিয়মে সেদিনের শাসক আজ বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আর জনতার ভালবাসায় চিরকালীন হয়ে উঠেছে কিশোরের গান।
আরও শুনুন: নকল করছিলেন শচীনকত্তার কণ্ঠস্বর, হঠাৎ তাঁকে দেখেই জানলা গলে উধাও কিশোরকুমার
তবে সেদিন, শাসকের পদক্ষেপে একটা কথা ছিল স্পষ্ট। দেশের মন যদি কেউ জিততে পারেন, তবে তা কিশোরের কণ্ঠই। এইখানেই বোধহয়য় জিতে যান শিল্পী। এমনকী ক্ষমতা তার নিজের প্রয়োজনে হলেও স্বীকার করে নেয় শিল্পীর ক্ষমতা। আসলে কিশোর কুমার জিতে গিয়েছেন তাঁর দিলদরিয়া মন আর মেজাজে। কেউ বলবেন, সুরের দুনিয়ায় তিনি যেন বাউল বাতাস। রাজা সাজতে তিনি আসেননি। এসেছিলেন মানুষকে দু-দণ্ডের শান্তি দিতে। আর মানুষ তাঁকেই নির্দ্বিধায় তুলে দিয়েছেন মনের রাজসিংহাসনে। আজ, বহুকাল পেরিয়েও আমরা যখন কিশোরের গানের কাছেই আমাদের হাসি-কান্নার ঠিকানা খুঁজে পাই, তখন বোঝা চায়, সত্যিকার রাজা চিনতে জনতা কোনোদিন ভুল করেনি। শাসকের দম্ভও একদিন ধুলোয় মেশে। আর সময়ের ধুলো উড়িয়ে চিরনতুনেরে ডাক দেয় শিল্পীর গান। কিশোর কুমার গণমানুষের মনে মনে লিখে রেখেছেন তাঁর গানের স্বরলিপি। যতদিন মানুষ থাকবে, যতদিন মানুষ নিজেকে প্রকাশের জন্য যাবে সুরের কাছে, ততদিন মুছবে না সেই স্বরলিপি। মানুষকে ভালবাসতেন কিশোর কুমার। মানুষের ভালবাসাই তাঁকে তাই করে তুলেছে অমরশিল্পী।