প্রেম হারানো সর্বস্বান্ত দিনে, বন্ধু হারানোর মেঘলা বিষাদে বন্ধু হয়ে যে মানুষটি সুরেলা পথে হাত ধরে নিয়ে যেতেন কোনও এক অচিন পছন্দপুরে… না, সেই কেকে আর নেই। কেকে নেই – নিষ্ঠুর এই সত্যি। অস্বীকারের উপায় নেই। তবু মেনে নিতে ইচ্ছে করে না কিছুতেই।
কাঁদছে কলকাতা। কাঁদছে গোটা দেশ। জীবনের সকল ক্ষতের উপর যে মানুষটি বুলিয়ে দিতেন সুরের উপশম, গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে এলে যাঁর কণ্ঠ হয়ে উঠত অমোঘ আশ্রয়… না, সেই মানুষটাই যে আর নেই।
প্রেম হারানো সর্বস্বান্ত দিনে, বন্ধু হারানোর মেঘলা বিষাদে বন্ধু হয়ে যে মানুষটি সুরেলা পথে হাত ধরে নিয়ে যেতেন কোনও এক অচিন পছন্দপুরে… না, সেই কেকে আর নেই।
কেকে নেই – নিষ্ঠুর এই সত্যি। অস্বীকারের উপায় নেই। তবু মেনে নিতে ইচ্ছে করে না কিছুতেই।
ফিরে তাকালে মনে হয়, এই যেন সেদিনের কথা। নব্বইয়ের আলো গায়ে মেখে তৈরি হচ্ছে এক নতুন প্রজন্ম। অর্থনীতি আর রাজনীতির বদল এসে বদলে দিচ্ছে মানুষের মন। মনের মানুষকে একটু যেন অন্যভাবেই পেতে চায় এ-প্রজন্ম। সেই বাসনার রঙে একটু একটু করে রেঙে উঠছে সংস্কৃতির নতুন চালচিত্র। বদলে যাচ্ছে সুরের সফর। ইন্ডি-পপের নয়া চলনে বুঁদ গোটা প্রজন্ম। এইরকম দিনকালেই এসেছিলেন কে কে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ যেদিন বলে উঠল – হাম রহে না রহে কাল – একটা প্রজন্ম যেন সেদিনই খুঁজে পেল আবেগের ভাষা। কথা-সুরে বহু জীবনের তার এমন করে বেঁধে দিলেন কে কে, সেদিন যেন সকলেই এক চুমুকে পান করে নিতে চেয়েছিল জীবন নামের পানীয়টিকে। কেননা, ততদিনে সবাই আঁকড়ে ধরেছেন সেই সুরকে, সেই কথাকে, যা শিখিয়ে দেয় – ছোটিসি হ্যায় জিন্দেগি…
তারপর কত গান। কত ‘বিতহে লমহে’র গোধূলি নেমেছে সুরের বারান্দায়। প্রেমিকার চোখের আজবসি আদায়ে তাঁর গান ছুঁয়েই তো চিনেছে কত প্রেমিক। খুঁজে ফেরা আশিয়ানার কত জোনাকি আলো ছড়িয়েছে তাঁরই গানের পথে পথে। আর কে কে ক্রমে পেরিয়ে গিয়েছেন প্রজন্মের পরিধি। কত মন আনচান করা রাত তাঁর গানেই খুঁজে পেয়েছে ‘দিল ইবাদত’। যেন তাঁর গানের ভিতর রাখা নম্র নদীটির জল আঁজলা ভরে তুলে নিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এ জীবন অসম্ভব ক্ষতপ্রবণ। এ জীবন তীব্র খর্খরে বাস্তব, চোখের জলে নোনতা। এ জীবনে হেরে যাওয়া দিন নেমে আসে চট করে। আর সে সবের উলটো দিকে যেন আলাদা এক পৃথিবী হয়ে থেকে যায় কে কে-র গান। যে গানে স্বপ্নের পৃথিবীতে বসন্ত নামে অচেনা কোনও রঙে। যে পৃথিবী বেঁচে থাকে গহন মনের অন্তঃপুরে। কে কে-র গান তাই মনের দরজায় অতিথি হয়ে থাকে না, বরং হয়ে ওঠে অন্তরমহলের আপনজন।
সেই কেকে চলে গেলেন আচমকাই। মনখারাপের মেঘ তাই নেমেছে কয়েক প্রজন্মের আকাশ জুড়ে। থমথমে আজ সেই কলেজ চত্বর, যেখানে একদিন বন্ধুরা গেয়ে উঠেছিল কেকে-র গান। বিষণ্ণ সেই যুগল, কে কে-র গান যাদের একদিন মিলিয়ে দিয়েছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত আলিঙ্গনে। মনখারাপ সেই গিটারের, যার তারে তারে অপটু আঙুলের ছোঁয়ায় কত রাতে একা একা বেজে উঠত কেকে-র গান।
আর এই সমস্ত মনখারাপের ভিতরই যেন লেখা হয়ে আছে একজন শিল্পীর অমরত্বের বন্দনাগান। শিল্পীর তো মৃত্যু নেই। কে বলে কেকে নেই! কেকে থেকে যাবেন কোনও আনমনা বিকেলের একচিলতে বেদনা হয়ে। কেকে থেকে যাবেন ঘুম না আসা রাতে সুরের আদর হয়ে। আসলে কেকে থাকবেন আমাদেরই হৃদমাঝারে। ইহলোকের মায়া তিনি কাটালেও, তাঁর সুরের মায়াকে আমরা ছেড়ে দেব না কিছুতেই।