কিছুদিন আগে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া তথ্যচিত্র দ্য সোশ্যাল ডিলেমা আমাদের এই মায়াভরা ডিজিটাল দুনিয়ার নানাবিধ জটিল পর্দার কয়েকটি উন্মুক্ত করে দেখাতে চেয়েছে, আমাদের নিরন্তর বেড়ে চলা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিকশনের ফল ভাঙিয়ে আসলে কার লাভ হচ্ছে – আসলে কারা নিরন্তর আমাদের এই অদ্ভুত এক জালের মত চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে, দেখতে পেলেও, বুঝতে পেলেও, মাঝে মাঝে অনুভব করতে পেলেও যে জাল ছিড়ে আমাদের বেরোনোর উপায় নেই। এ যেন যাবজ্জীবন কারাদন্ড, অথচ কারাগারের কোনো লৌহকপাট নেই। লৌহকপাট যদি চোখেই দেখতে না পাই, তাহলে তা আর ভেঙে বেরোবো কী করে?
সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল এই মাধ্যম নিয়ে এক ধরণের সন্দেহ আমাদের জন্য নতুন নয়। আমরা সবাই কমবেশী জানি, ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়। এই তথ্যচিত্রের অন্যতম প্রধাণ মুখ, ২০১৫ সালে গুগুল ছেড়ে এসে নন-প্রফিট সংস্থা ‘সেন্টার ফর হিউমেন টেকনোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা ত্রিস্তান হ্যারিস, যাঁর সম্পর্কে অনেকেই বলেন, ‘সিলিকন ভ্যালি’তে যদি বিবেক বলে সবচেয়ে কাছাকাছি কিছু থাকে তাহলে, তিনি ত্রিস্তান।
ত্রিস্তান বলছেন, মানুষের ইতিহাসে আগে কখনও এরকম হয়নি যে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে থাকা পঁচিশ থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়সের মাত্র পঞ্চাশ জন টেক-ডিজাইনার কার্যত ঠিক করে দিচ্ছেন, দু’শো কোটি মানুষ রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কীভাবে ‘নোটিফিকেশন চেক’ করবেন।
আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি, তাদের ধারণা– নিয়ন্ত্রক তো আমরা – আমরাই তো নিজেদের ইচ্ছেয় লাইক করছি, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি, বন্ধুর সাথে চ্যাট করছি! ত্রিস্তানরা বলছেন না – এটা আপনি করছেন না, আপনাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। খানিকটা পুতুলনাচের মতো – যার অদৃশ্য সুতোটা থাকছে প্রতিনিয়ত কোটি ডলার কামানো টেক-ইন্ডাস্ট্রির কিছু কোম্পানির হাতে, তারাই আপনাকে বলে দিচ্ছে, কখন ‘নোটিফিকেশন চেক’ করতে হবে আর কখন মেসেঞ্জারে ওয়েভ পাঠাতে হবে!
এখানকার কর্মীরাই বলছেন, এই সমস্ত কোম্পানির ব্যবসার মডেল হল, কত বেশী সময়, আরও কত বেশী সময়, আরও আরও কত বেশী সময়, আপনার থেকে কেড়ে নেওয়া যায় – যেখানে আপনি স্ক্রল করেই যাবেন – বিরতিহীন, সমাপ্তিহীন, অনন্ত সময়ের স্ক্রল – আপনার এই প্রতি সেকেন্ড সময় অনলাইনে থাকার জন্য, আসলে টাকা তৈরী হচ্ছে – জায়ান্ট কম্পিউটার স্ক্রিন বসে আছে আপনাকে, আপনার সময়কে টাকার সংখ্যায় পরিবর্তন করে নেওয়ার জন্য।
লেখা: সায়ন্তন দত্ত
পাঠ: কোরক সামন্ত
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস