যেভাবে অনুরাগ সময়ের দাম বেঁধে দিয়েছেন, তা আহত করেছে অনেককেই। তবে, মূল যে জায়গাটা উসকে দিলেন, তা মোটেও লঘু বা তরল নয়। সকলকে সন্তুষ্ট করার দায় মাথায় নিয়ে কি কেউ চলতে পারেন? মতে হোক, মন্তব্যে হোক কিংবা নতুনদের সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে?
সময়ের যে দাম আছে সে তো সকলেরই জানা কথা। তবে আক্ষরিক সে দাম যে কী হতে পারে, তা এত স্পষ্ট করে আগে কেউ বলেননি সম্ভবত। বললেন পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। রীতিমতো রেট কার্ড বেঁধে দিয়েছেন তিনি। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের জন্য ১ লাখ টাকা। আধ ঘণ্টার জন্য ২ লাখ, আর ঘণ্টাখানেক সঙ্গে অনুরাগ হলে পকেটে কোপ পাক্কা ৫ লাখের। এ নিয়ে আবার কেউ কেউ অঙ্কে ফিরে গিয়েছেন। যে, ১৫ মিনিট করে বার চারেক কথা বললে ৪ লাখেই ব্যাপারটা মিটে যায়। তাহলে ঘণ্টায় ৫ লাখ টাকা কেউ দিতে যাবেন কেন? তবে গাণিতিক তর্ক বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, তা হল, সময়কে একেবারে মানিব্যাগে পুরে ফেলা। বিশেষত অনুরাগ কাশ্যপের মতো পরিচালক যখন এ কথা বলেন, তখন অনেকের ভুরু কুঁচকে যাওয়া স্বাভাবিক, এবং তা হয়েওছে।
-: আরও শুনুন :-
অনুরাগে যত রাগ! যেন সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া হারানোর কিছুই নেই
তরুণ সিনেপ্রেমীদের মধ্যে অনুরাগের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। সিনেমাশিল্পে তিনি নিজের একটি ভাষা তৈরি করেছেন। যা পথ দেখিয়েছে বহু তরুণ পরিচালককে। যাঁরা সিনেমা নির্মাণ করেন না, তাঁরাও অনুরাগের এই সিনেভাষার অনুরাগী। ফলত তিনি কী কাজ করছেন, কী বলছেন তাঁর নিক্তিমাপা হিসেব রাখেন অনেকেই। সেই হিসাবেই গরমিল দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক এই মন্তব্যে। অনেকেরই মত এই যে, যে কথা বলেছেন তা মোটেও অনুরাগের মুখে মানায় না। বলিউডের সিনেমহলে পা রাখা যে নতুনদের জন্য বেশ শক্ত ব্যাপার, তা আর নতুন করে বলার কিছু নয়। বলিউডের যারা ঘরের ছেলে কিংবা মেয়ে, তাঁরা যত সহজে সুযোগের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেন, বাকিদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। ফলত যে ‘নেপোটিজম’ বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছিল, তা একেবারে অসার, এমনটা বলা যায় না। তবে, তার পালটা যুক্তি আছে। সুযোগ পেলেই যে সকলে সফল হবেন, এর কোনও মানে নেই। তা যে সেলেবের পুত্র বা কন্যাই তিনি হোন না কেন, দর্শকের রুচিই শেষমেশ স্থির করে, পর্দায় কে থাকবেন আর থাকবেন না। তবু একটি কথা অনস্বীকার্য যে, এই সুযোগের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছোনই বড় ব্যাপার। যে তরুণ বা তরুণী দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে বলিউডের দরজায় অপেক্ষা করেন, তাঁদের কাছে এই রুদ্ধদ্বার খোলার উপায় সহজ নয়। ফলত ব্রাত্যজন হয়ে থাকাই নিয়তি।
অনুরাগ নিজেও এরকমই ‘বহিরাগত’ হয়েই একদিন এসেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। এ যন্ত্রণা তিনি মর্মে মর্মেই বোঝেন। এ কথা সত্যি যে, এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই তিনি আশ্রয়ের মতো। নতুন চিত্রনাট্য নিয়ে যিনি ঘুরছেন, তাঁর কাছে করণ জোহরের থেকে অনুরাগ অনেক বেশি প্রিয়। অনুরাগ নিজেও এতদিন সে জায়গা দিয়েছেন। সেই তিনি যখন এমন সময়ের দাম বেঁধে দিয়েছেন, তখন অনেকেই আশ্চর্য হয়েছে। তা হওয়ারই কথা বটে। তবে, এর মধ্যে ভেবে দেখারও দু-একটা কথা আছে। কথা হল, অনুরাগ কি সকলের চাহিদা পূরণ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন? তা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, সে সমস্যার মোকাবিলা অন্য ভাবেও হয়তো করা যেত। এমন প্রকাশ্যে সময়ের দাম বাঁধা রেট কার্ড না ঝুলিয়ে দিলেও চলত। দ্বিতীয় সম্ভাব্য প্রসঙ্গটির সূচনা এখান থেকেই। সম্প্রতি অনুরাগ এমন কয়েকটি মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। প্রথমত ‘অ্যানিমাল’ ছবির পরিচালককে দরাজ সার্টিফিকেট দেওয়া। ছবিটিকে ‘গেম চেঞ্জার’ তকমা দিতেও দ্বিধা করেননি। অথচ সেই ছবি নিয়ে সমালোচনার অন্ত ছিল না। বিশেষত যে ছবিতে নারীবিদ্বেষ প্রকট, সে ছবিকে অনুরাগ কীভাবে সমর্থন করছেন, তা ভেবে পাননি কেউই। বলিউডে তাঁর অনুজ পরিচালকরা এর বিরোধিতাও করেছিলেন। সংক্ষেপে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, অনুরাগের মতের সঙ্গে মিল নেই তাঁদের। তবে, অনুরাগ বলতে চাইছিলেন,ছবি যে এত ‘হিট’, তার কারণ এবং সেই সূত্রে দর্শকমানসের বাস্তবতা আরও তলিয়ে দেখা উচিত। যদিও তাঁর বক্তব্য মন্তব্যের অতিসরলীকরণে মিলিয়ে গিয়েছিল। বর্তমান বাংলা সিনেমাকে তো একেবারে ‘ঘাটিয়া’ বলেছিলেন অনুরাগ, যা নিয়েও তুমুল বিতর্ক হয়েছে। মন্তব্য তীক্ষ্ণ, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে, তলিয়ে দেখলে তার ভিতর সারসত্য যে কিছু খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, তা-ও বোধহয় অস্বীকার করা যায় না। তর্কে-বিতর্কে মূল কথা থেকেই আলো সরে গিয়েছে, বরং বেশি আলোচিত হয়েছে ওই ‘ঘাটিয়া’ শব্দটিই। অথচ অনুরাগ বলেছিলেন, যদি সত্যিই কোনও পরিবর্তন আনতে হয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে, তাহলে ফোন আর ট্যাবে মুখ গুঁজে বসে থেকে লাভ নেই। এ কথা নিয়ে আলোচনা প্রায় ছিলই না। অনুমান কয়া যায়, অনুরাগ সম্ভবত চলতি মানসিকতাকে সন্তুষ্ট করার দায় থেকে অব্যাহতি চাইছেন। তাঁর মত এবং মন্তব্য যদি তলিয়ে দেখা যায়, তবেই ভিতরের কথাটা বোঝা যায়; নইলে শুধু বাইরের অংশটুকুতেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। এই জায়গা থেকেই বোধহয়, ‘কে কী ভাববেন’ এ নিয়ে তিনি আর ভাবিত হতে চাইছেন না। তাঁর অনুরাগীদের সন্তুষ্ট করার দিকটিতেও সেভাবে আর মন দিতে পারছেন না তিনি। কেননা সময়ের মন-মেজাজ-মর্জি বেশ ভালই বুঝতে পারছেন। তা যতটা মুখর, ততটাই অন্তঃসারশূন্য।
যেভাবে তিনি সময়ের দাম বেঁধে দিয়েছেন, তা আহত করেছে অনেককেই। তবে, মূল যে জায়গাটা উসকে দিলেন অনুরাগ, তা মোটেও লঘু বা তরল নয়। সকলকে সন্তুষ্ট করার দায় মাথায় নিয়ে কি কেউ চলতে পারেন? মতে হোক, মন্তব্যে হোক কিংবা নতুনদের সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে? বোধহয় না। এই সত্যি হাটের মাঝে খুলেই বলে ফেলেছেন অনুরাগ। আর কেউ হলে হয়তো এভাবে বলতেন না। যাঁরা প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের কাছে আম-আদমির প্রত্যাশা নানা রকমের। তবে, যে সময়টা কেবল একতরফা সিদ্ধান্ত টানতেই ব্যস্ত, সেখানে সবার মন রেখে চলা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যেখানে সমালোচনা বা তর্ক জলাঞ্জলিতে, শুধু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তি-আক্রমণ, সেখানে একজন ব্যক্তির নিজস্ব অবস্থানে থিতু থাকাই শ্রেয়। ‘কে কী মনে করবেন’ ভেবে আর পথ চলার উপায় থাকে না। অনুরাগ সিনেমার ক্ষেত্রেও তা ভাবেননি, বাস্তবেও নয়।
হয়তো তরুণদের সঙ্গে বিনা পয়সাতেই তিনি আবার দেখা করবেন। তবে, ভিড়ের মন রাখার দায় যে শিল্পীর কাঁধে বর্তায় না, এ কথা বেশ করেই বুঝিয়ে দিলেন অনুরাগ কাশ্যপ। এই প্রসঙ্গটা কিন্তু একেবারেই ‘ঘাটিয়া’ নয়, বরং ভেবে দেখার মতোই।