একজন অভিনেতা নিখুঁত ভাবে চরিত্রে অভিনয় করবেন। এ তো জানা কথাই। তবু শুধু এটুকুতেই বোধহয় একজন অভিনেতা মহৎ হয়ে উঠতে পারেন না। তিনিই পারেন, যাঁর মন আজীবন শিক্ষার্থী হয়ে থাকে। এমনকী পাশে খ্যাতনামা পরিচালক থাকলেও, সাধারণ মানুষের সার্টিফিকেট পেয়ে তবে যিনি ভরসা পান বা নিশ্চিন্ত হন, তিনিই বোধহয় হয়ে উঠতে পারেন অনন্যসাধারণ। আমরা কথা বলছি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। আসুন শুনে নিই সেই গল্প।
স্বয়ং নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। সিনেমায় হাতেখড়ি সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের ছবিতে। ওদিকে তপন সিংহের মতো পরিচালকের ছবিতেও কাজ করেছেন একেবারে শুরুর দিকেই। তাঁর অভিনয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলায়। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি একবার সাধারণ গ্রামের মানুষের তারিফ শুনে, তবে তাঁর অভিনয় নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
আরও শুনুন – ফেলুদার প্রতি ‘দুর্বলতা’ নেই, জানিয়ে কিশোরী ভক্তের ‘তিরস্কার’ জুটেছিল সৌমিত্রর
তখন ‘অশনি সংকেত’ ছবিটি শুরু হওয়ার পথে। বরাবরের মতোই চরিত্র নিয়ে হোমওয়ার্ক করছেন সৌমিত্র। খাতার পাতায় ধরা পড়ছে চরিত্র নিয়ে তাঁর নানা ভাবনা। এই ছবিটা তিনি মনেপ্রাণে করতে চাইছিলেন। কেন? খাতায় তিনি লিখে রেখেছিলেন সে-কথা। লিখেছিলেন, – ‘দারিদ্রই দুর্ভিক্ষের কারণ বলে সখারাম গণেশ দেউসকর প্রমাণ করেছেন। অতএব ভারতবর্ষের সচেতন শিল্পীর কাছে যেটা সবথেকে প্রত্যক্ষ ও প্রধান পীড়া ও ক্ষোভের কারণ – অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত ও কৃষিজীবী বাঙালির দারিদ্র ও অসহায়তা – তার বিরুদ্ধে টিঁকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা, কিন্তু সংগঠিত সচেতন সংগ্রাম নয় – সেই কারণটিকেই এই ছবিতে খানিকটা দেখানো যেতে পারে বলে অশনি সংকেত করতে আমার এত ইচ্ছা করছে। এটাই আমার কাছে এর প্রধান আকর্ষণ।’
আরও শুনুন – সৌমিত্র কি সত্যিই অমন ফরসা? গায়ে চিমটি কেটে দেখেছিলেন অজানা ভক্ত
এই ভাবনা থেকেই গঙ্গাচরণ হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেন সৌমিত্র। দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে গা চুলকানোর ধরন এবং কতরকম ভাবে ধুতি পরা যেতে পারে- তা নিয়েও ভাবছেন সৌমিত্র। ভাবছেন, খালি গা থাকলে পৈতেটা ভাঁজ করে কাঁধে তোলা যেতে পারে। এইরকম টুকর চিন্তাগুলো লিখেও রাখছেন খাতায়। কেমন ভাবে হাঁটবে গঙ্গাচরণ? কী অসামান্য পর্যবেক্ষণ তাঁর। তিনি লক্ষ করলেন, গাঁয়ের মানুষ শর্ট স্টেপ-এ তেমন করে হাঁটেন না। অতএব পা ফেলাটা লম্বা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
আরও শুনুন- ‘লবেঞ্চুস মার্কা হিরো’ নয়, নায়কের ধারণায় বদল আনার নায়ক সৌমিত্রই
সৌমিত্রর খাতা জানাচ্ছে, ১৯৭২-এর ৩০ জুলাই শুরু হয় অশনি সংকেতের শুটিং। তবে তার আগেই কিছু কিছু শট নিয়ে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সৌমিত্রর শুটিং শুরু হল সেই দিন থেকেই। বেশ কিছু দিন পর ওই বছরেরই নভেম্বরের ১৩ তারিখ তিনি খাতায় লিখছেন যে, তাঁর কাজ শেষ হল। একটা অদ্ভুত রিক্ততা সেদিন তাঁর মন জুড়ে। যে চরিত্রটাকে নিয়ে এতদিন, এতরকম ভাবনা ভেবেছেন, তার কাজ শেষ হল। সেদিনই কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে তাঁর গল্প হচ্ছিল। তাঁরা জানান যে, সৌমিত্রর অভিনয় তাঁদের খুব ভালো লেগেছে। তিনি যে গ্রামের লোক নন, তা দেখে কে বলবে! এরপরই সৌমিত্র লিখছেন, ‘ এই কথা শুনে একটু ভরসা হচ্ছে – তাহলে হয়তো কাজটা ঠিকই হয়েছে।’
এই হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গ্রামের মানুষের যে চরিত্র তিনি হয়ে উঠতে চাইছেন বিস্তর হোমওয়ার্ক করে, সেই সাধারণ গ্রামবাসী যখন তাঁকে শংসাপত্র দিচ্ছেন, তখন নিশ্চিন্ত বোধ করছেন তিনি। এই কারণেই তিনি শুধু বড় অভিনেতা নন, এই দেশের একজন মহৎ অভিনেতা। জন্মদিনে কিংবদন্তি এই শিল্পীকে আমাদের প্রণাম।