স্বাধীনতা চেয়ে যে প্রতিবাদ, সে প্রতিবাদের কোনও বাঁধাধরা বর্ণমালা হতে নেই। তার ভাষা, কিংবা তার ভাষাহীন নীরবতাও হোক স্বাধীন। স্ব-এর অধীন। আহু দারিয়াই-এর মতো, কিংবা মণিপুরের মায়েদের মতো, কিংবা সাহার খোদায়েরি-র মতো, সেই নতুন বর্ণমালা লেখা হোক প্রতিবাদীর নিজেরই হাতে!
মৃত্যুদণ্ডের সামনে মেয়ের অন্তর্বাস পরে দাঁড়ানোর নাম ‘সাহস’। যে সাহসের ছবি দেখছে গোটা বিশ্ব। সে ছবিতে অন্তর্বাস পরে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে এক মেয়ে। তার চারপাশে সারা শরীর ঢেকে রাখার ফতোয়া। তার মধ্যেই সে নিজেকে উন্মুক্ত করেছে। সেই উন্মুক্ত শরীর যেন নিজেই এক হাতিয়ার, যেন এক খাপখোলা তলোয়ার। ঠিক যেমন কয়েক বছর আগে, সে দেশেই চুল উড়ছিল পতাকা হয়ে, যে চুলের সূর্য দেখা বারণ। যে দেশে ঠিকমতো হিজাব পরেনি বলেই মরে যেতে হয়েছিল মাহসা আমিনিকে। আর তারপর, মাহসা আমিনির নাম নিয়েই রাস্তায় নেমে এসেছিলেন ইরানের লক্ষ লক্ষ মেয়ে। যে চুল ঢেকে রাখার জন্য এত নিদান, সেই লম্বা চুল কেটে পতাকা বানিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। যে শরীরকে ঢেকে রাখার জন্য এত রক্তচক্ষু, সেই শরীরকেই ভরা রাস্তায় উন্মুক্ত করেছিলেন তাঁরা। আর সেই ক্যানভাসেই রক্তের অক্ষরে ফুটে উঠেছিল মাহসা আমিনির নাম।
আবার রক্তের নয়, আগুনের অক্ষরে প্রতিবাদ লিখেছিলেন সেই ইরানেরই সাহার খোদায়েরি। কেন তিনি পুরুষের ছদ্মবেশে ফুটবল স্টেডিয়ামে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন, সেই অপরাধের বিচার হচ্ছে যখন, রায় বেরোবার দিনটিতেই আদালত চত্বরেই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। সেদিনও সাহার খোদায়েরির পুড়তে থাকা শরীর থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে গিয়েছিল সারা ইরানে। গড়ে উঠেছিল প্রতিবাদের নয়া বয়ান। কোনও ‘মেয়েদের যা করা উচিত’-সুলভ তত্ত্বের ছায়ায় নয়, তাঁরা নিজেরাই লিখেছিলেন নিজেদের প্রতিবাদের বর্ণমালা।
ঠিক তেমনই, নিজের মতো করেই নিজের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিয়েছেন আহু দারিয়াই। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই। যে দেশে মাথায় হিজাব না পরলে মাহসা আমিনি হতে হয়, সে দেশে হিজাব না পরা কোনও শৌখিন ঘটনা নয়। সে দেশে হিজাব না পরার অপরাধে নীতিপুলিশেরা কাপড় ধরে টান মারলে সমস্ত পোশাক খুলে ফেলা কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। অন্তর্বাস পরে নিজের মতো করে হেঁটে চলা আসলে এক জোরালো স্লোগান- নিজের মতো থাকার। অন্য কারও নির্দেশ না মেনে কেবলমাত্র স্ব-এর অধীন থাকার। যাকে আমরা স্বাধীনতা বলে চিনি। এই হাঁটা সেই স্বাধীনতার পথে, কারাবাস কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও।
নারীর প্রতিবাদ অনেকসময়ই ভাষা খুঁজে পেয়েছে নগ্নতায়। কেননা নারীকে তার নিজের শরীরের অধিকার দিতে চায় না কেউই। না পুরুষ, না পরিবার, না রাষ্ট্র। তাই নারীর কাছে নিজের শরীরকে নিজের হাতে নেওয়ার, নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার চিহ্ন হয়ে ওঠে নগ্নতা। ২০০৮ সালে ইউক্রেনে শুরু হয়েছিল ‘ফিমেন’ নামে এক গোষ্ঠী, যা যা মেয়েদের যৌন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা এবং তাদের উপরে হওয়ায় যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নগ্ন প্রতিবাদে শামিল হয়ে চলেছে, নিরন্তর। ২০১০ সাল নাগাদ, আরব বসন্তের সময় ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন মেয়েরা। নেট দুনিয়ায় আছড়ে পড়েছিল তাঁদের একের পর এক নগ্ন ছবি। অসম রাইফেলস-এর সেনাদের হাতে মনোরমার ধর্ষণ-মৃত্যুর পর যখন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মণিপুরের মায়েরা, কিংবা নগ্ন শরীরে ইউক্রেনের পতাকার রং বয়ে এনে কান ফেস্টিভ্যালে যুদ্ধবিরোধী বার্তা দিয়েছিলেন যে তরুণী- তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানবতা লাঞ্ছিত হলে, পোশাকের শালীনতা কি আর মানুষকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে ঢেকে রাখতে পারে! জানিয়ে দিয়েছেন, নগ্নতা কেবল ফ্যান্টাসি নয়, পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সমাজে তা কেবল পণ্যবস্তু নয়, বরং তাই-ই হয়ে উঠতে পারে ধারালো তলোয়ারও। সেই প্রতিবাদী তলোয়ারের সামনে আজও দু-দণ্ড থমকে দাঁড়াতে হয় দুর্বিনীত সভ্যতাকেই।
আসলে স্বাধীনতা চেয়ে যেমন এই প্রতিবাদ, তার উলটোদিকে এ কথাও বলার থাকে যে, প্রতিবাদ কেমন ভাষায় হবে তারও স্বাধীনতা থাকা জরুরি। অরুন্ধতী রায় যেমন বলেন, ‘আমি বলি না যে শোষিতরা শোষকের বিরুদ্ধে কোন পথে আন্দোলন করবেন। তা তাঁরা ঠিক করবেন নিজেরাই!’ কে পথে নামবেন, কে স্লোগান তুলবেন, কে নগ্নতাকেই প্রতিবাদের নিশান করবেন- এই সবকিছুকে নিজে নির্বাচন করতে পারাই আসলে স্বাধীনতা। এমনকি নীরব হয়ে থাকাও। যে অবদমন অন্য কাউকে ‘কী করবে না’-র নির্দেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেখান থেকে স্বাধীনতা চাওয়ার জন্য প্রতিবাদে কখনোই ‘কী করবে’-র ফতোয়া থাকতে পারে না আসলে। তাই সে প্রতিবাদ পোশাক পরে বা না পরে, খেয়ে বা না খেয়ে, হেসে বা কেঁদে, যেমন খুশি হতে পারে। তার ভাষা, কিংবা তার ভাষাহীন নীরবতাও হোক স্বাধীন। কেননা, নিজের যা ইচ্ছে, অন্য কারও ক্ষতি না করে তেমনভাবে চলতে পারার নামই স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতার কোনও বাঁধাধরা বর্ণমালা থাকতে নেই। আহু দারিয়াই-এর মতো, কিংবা মণিপুরের মায়েদের মতো, কিংবা সাহার খোদায়েরি-র মতো, সেই নতুন বর্ণমালা লেখা হোক প্রতিবাদীর নিজেরই হাতে!
[ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক]