চলচ্চিত্র জগৎ হারাল এক নক্ষত্রকে।
বাংলা সিনেমার জলসাঘরে নিবল অভিজাত ঝাড়বাতিটি। মেধাদীপ্ত যে-আলোয় কয়েক দশক বাংলাভাষায় নির্মিত সিনেমা খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব চলার পথ, প্রয়াত হলেন সেই অগ্রপথিক। চলে গেলেন কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদার।
সিনেমার পোকা যে একদিন তাঁকে কুটুস করে কামড়েছিল, তা বুঝতে গোড়ায় খানিক সময়ই নিয়েছিলেন। আত্মজীবনী নয়, সিনেমাপাড়ায় হাঁটার ইতিবৃত্তে নিজের সিনেমাজীবনের শুরুটা এভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন তরুণবাবু। তখন সবে কলেজজীবন পেরিয়েছেন, সিনেমার মায়া পেয়ে বসল তাঁকে। আলো-ছায়ার এই পৃথিবীতে একদিন ঢুকে পড়লেন নিঃশব্দেই। তারপর থেকে অবিরাম তাঁর পথচলা। আর সে চলা যত দীর্ঘ হয়েছে, বাঙালি উপহার পেয়েছে বাংলা সিনেমার এক স্বতন্ত্র ঘরানা। বলা যায়, বাংলা সিনেমার দর্শকই হেঁটেছে তরুণ মজুমদারের নিজস্ব সিনেমাপাড়া দিয়ে।
আরও শুনুন: ‘নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ সিনেমাপাড়ার তরুণকে পরিচালনায় আসার ডাক উত্তমকুমারের
সিনেমা সম্মেলক শিল্প বা কমপোজিট আর্ট। সহজ নয় সেই শিল্পের অভীষ্ট বিন্দু স্পর্শ করা। এই বাংলা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মতো বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালককে পেয়েছে, যাঁরা নির্মাণ করেছেন বাংলা সিনেমা তথা বিশ্ব সিনেমার নতুন ভাষ্য। সেই পরিমণ্ডলেই তরুণ মজুমদার তৈরি করেছিলেন আবহমান অথচ বাঙালির একান্ত আপন এক সিনেমা-ভাষা। গল্পের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছিলেন নিজের কল্পনায় আর অসামান্য সিনেমা নির্মাণের কৌশলে। অথচ সাহিত্যবোধ থেকে বিচ্যুত হননি। ‘বালিকা বধূ’, ‘পলাতক’, ‘ফুলেশ্বরী’ কিংবা ‘দাদার কীর্তি’ বা ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ – একের পর এক ছবিতে আধুনিক বাঙালির মঙ্গলকাব্য বাঙালিকেই শুনিয়ে গিয়েছেন তরুণ মজুমদার। না, সেখানে বাহুল্য নেই। নেই প্রযুক্তির বিপুল কারসাজি। তবু আছে এমন কিছু, যে এই সব ছবিকে সংস্কৃতির সোনার ঘরে তুলে রাখতে মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেনি বাঙালি দর্শক। আসলে তরুণ মজুমদার বাঙালিকে উপহার দিয়েছিলেন সরল জীবনের ভিতর লুকিয়ে থাকা অপরিসীম বিস্ময়। সামান্য গল্পের ভিতর লুকিয়ে যে অনন্তের হাতছানি, সাধারণ কাহিনির আড়েও যে আঁজলা ভরে তুলে নেওয়া যায় জীবনপ্রবাহের অসামান্যতাকে – তাই-ই যেন আমাদের সিনেমা থেকে সিনেমায় দেখিয়ে দেন তরুণ মজুমদার। আসলে জীবনের যে অপার মাধুর্য তার-ই মায়াময় স্পর্শ তিনি বুলিয়ে দেন তাঁর সিনেমাভুবনের আঙিনায়। মার্কসীয় অভিজ্ঞানই কি তরুণবাবুকে জীবনের প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার প্রতি এমন মমত্বময় করে তুলেছিল? সে উত্তর নিশ্চিতই খুঁজবেন সমালোচক কিংবা সিনেমা তাত্ত্বিকরা। বাঙালি দর্শক শুধু বুঁদ হয়ে থেকেছে, থাকবে তাঁর সিনেমার মায়ায়। এমন মায়াবি সিনেকথন আর কার হাতেই বা লেখা হতে পারত! অদ্বিতীয় তরুণ মজুমদার বাঙালির জীবনচিত্রের নিপুণ শিল্পী, তাঁর ক্যানভাস শুধু সিনেমার পর্দা – এই যা।
আরও শুনুন: ‘আপনার ফ্লোরে থাকা দরকার’ জ্বরে কাতর তরুণ মজুমদারের পাশে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুচিত্রা
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়ের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী বাংলা ছবির জগতে পা রেখেছেন তাঁর হাত ধরেই। প্রচারবিমুখ স্বল্পভাষী মানুষটি তাঁদের সঙ্গে নিয়েই বাঙালির জন্য নির্মাণ করেছেন এক-একটি অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। আজ এই ঘোরতর প্রযুক্তির যুগে, আজ এই তথ্যের বিস্ফোরণের সময়ে বসে সেই অঙ্গুরীয়র দিকে চোখ পড়লে যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি আমাদের স্মৃতি, সত্তা এবং ভবিষ্যৎকেও। অবিস্মরণীয় কিছু গান-ও তো তিনি উপহার দিয়েছেন তাঁর ছবিতে। বাংলার নিজস্ব সুরের হয়েছে প্রাণপ্রতিষ্ঠা, আধুনিক শিল্পের মধ্যে কীর্তনের আঙ্গিক বা লোকায়ত সুরের চল, যে কী অসামান্য প্রয়োগে ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে, তরুণ মজুমদারের সিনেমাগুলো যেন তার-ই বাস্তবিক উদাহরণ। ছবির সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের গানকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ভগীরথও ছিলেন তিনিই। এক দিক থেকে রবি ঠাকুরের গানকে যেভাবে সকলের অন্তরের সামগ্রী করে তুলেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, সিনেমাকে মাধ্যম করে সেই একই ব্রত যেন নিয়েছিলেন তরুণবাবুও। না, প্রচারের উচ্চনাদী জয়ঢাক তিনি কোনোদিন বাজাননি। তাঁর ছবিই যেন কথা বলেছে তাঁর হয়ে, পরিচালককে করে রেখেছে চিরবাঙ্ময়। জাতীয় পুরস্কার, পদ্মশ্রী-সহ বহু বহু সম্মান তিনি পেয়েছেন। এত স্বীকৃতি সত্ত্বেও তিনি যেন নির্জন পথের চিরকালের মৃদুভাষী এক পথিকই।
জাগতিক নিয়মেই চলে গেলেন তরুণবাবু। থেকে গেল তাঁর ছবি, ছবির গান, আর অসামান্য স্মৃতিকথন। মানুষকে তো চলে যেতেই হয়, সেভাবেই তাঁর চলে-যাওয়া। সিনেমাপাড়ায় তবু কিছু মায়া যেন থেকেই গেল।