বাঙালির পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বাঙালি। ঠিক আগের মতোই আছে! নাকি পয়লা বৈশাখ নেহাত পোশাকি উদযাপনে এসে ঠেকেছে? তা নিয়েই নিজের ভাবনা জানালেন, ঈশানী রায়চৌধুরী।
পড়ে শোনালেন: চৈতালী বক্সী। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক।
আমাদের নিতান্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারে পয়লা বৈশাখ তেমন জাঁকজমক করে আসত না। নতুন জামা হত কি না তা-ও মনে নেই। তবে, সন্ধেবেলা আমরা যেতাম বেঙ্গল কেমিক্যালের কোয়ার্টারে; মায়ের জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। সেখানে তখন মস্ত এক খাল ছিল। নৌকোও। আর লাল লাল বড় বড় একতলা বাড়ি। সেই সন্ধে ছিল উৎসবের সন্ধে। আমার সোনামাসির জন্মদিন ওই একই দিনে। মায়ের জেঠিমা মারা গিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের ছোটো রেখে; সন্ন্যাস রোগে। আমার দিদুই তখন থেকে একই সঙ্গে মা আর কাকিমা। ছোটোবেলা থেকেই জেনে এসেছি মায়েরা চার বোন। মা, বড়মাসি, সোনামাসি আর মাসিমণি। বড়মাসি আর সোনামাসি আসলে মায়ের জেঠুর দুই মেয়ে। সোনামাসি ছিল কিন্নরকণ্ঠী। পয়লা বৈশাখ তারই জন্মদিন। এক ঢিলে দুই পাখি। বর্ষবরণ আর জন্মদিন। বাঙালবাড়ি তো! রান্ধন আর খাওন …অজুহাত পেলেই হল! আর শুধু পেটপুজো করে নতুন বছর পালন করলে ঠাকুর পাপ দেন। তাই সঙ্গে থাকত গানবাজনার জমাটি আসর।
আমরা সব্বাই যেতাম। বাবা-মা-ঠাম্মা-দাদু আর আমি। ওই কোয়ার্টারের সব জানলা দরজা সন্ধেবেলা হাট করে খুলে দেওয়া হত। খালের থই-থই কালো জলে চাঁদের ছায়া পড়ত। মিঠে মিঠে গন্ধবিধুর বাতাস বইত। একপাশের বারান্দায় বেতের জাফরিকাটা আড়াল দেওয়া। সেই জাফরিতে মুখ চেপে দাঁড়ালে মুখে চৌখুপি নকশা তৈরি হত আর মনকেমনিয়া সুখে আমার চোখ বুজে আসত।
ভেতরের ঘরে তখন তবলায় চাঁটি, হারমোনিয়ামে সুরের ওঠাপড়া, তেপায়া টেবিলে কাচের পিরিচে উপচে পড়া ভিজে গন্ধরাজ আর বেল ফুল, ফুলদানিতেও কত কত ফুল, বড়মামুর হাতে ক্যামেরা, আর গান শুধু গান। তখন রেকর্ডার বসানো থাকত প্রত্যেকের মনের আনাচে কানাচে।
গান চলত। মাঝেমাঝে চা-শরবত-পান। টুকিটাকি খাবার। মিষ্টির থালা। সকলের খোঁপায় বা বেণিতে জড়ানো সাদা ফুল। আমি যার পিছনে বসতাম, তার চুলেই সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে গন্ধ চুরির ফিকির খুঁজতাম। আমার চাইনিজ কাট চুল। মাথায় সাদা রিবন। ফুল বসে না চুলে। সিল্কের ফ্রক। তাতে কী সুন্দর পুতুল এমব্রয়ডারি করা। সোনামাসি বানিয়ে দিয়েছে। আমি বসে থাকি। ভেবলি একটা!
রান্নাঘর। লম্বা বারান্দার ওধারে। মিষ্টি পোলাও আর মাংসের উচাটনী গন্ধ খাসা; কিন্তু ফুলের গন্ধ আরও ভালো।
সেই ফ্রকটা আজও আছে। কলকাতায়, বাক্সবন্দি। ন্যাপথালিনের গন্ধ মেখে। ফুলের গন্ধ মিলিয়ে গেছে অন্য কোথাও। সোনামাসি, বড়মাসি নেই। বড়মামু, দাদুভাই, দিদু, ঠাম্মা, দাদু… কেউ নেই। বড়মামুর দামি দামি ক্যামেরাগুলোও কী জানি কোথায়! এমনকি মস্ত বড় খালটাও নেই। শুধু কয়েকটা ছবি আছে; ভেবলির।
আর একটু বয়স বাড়ল যখন, যেটুকু মনে পড়ে, তাতে নতুন বই কেনা ছিল, সস্তার কাগজে ঠাকুরদেবতার ছবি আঁকা নতুন বাংলা দেওয়ালপঞ্জি ছিল। একসময়ে পয়লা বৈশাখে বাড়িতে পঞ্জিকা আসত… তাতে বৃহৎ লাল মূলা বা রাক্ষুসে বাঁধাকপির বিজ্ঞাপন, নিজের রাশিফল শুধু নয়… গুষ্টিগোত্তরের রাশিফল যাচাই করা ছিল এবং তা থেকে শুধু ভালো ভালো কথা মাথায় রেখে খারাপটি ভুলে যাওয়া ছিল, আর ছিল বইপাড়ায় দোকানে হালখাতার নেমন্তন্নে গিয়ে নামজাদা লেখকদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিপাত। ঠান্ডা ডাবের জল, লিমকা ওই মুগ্ধতার ঘূর্ণিপাকে অজান্তেই তেতে উঠত, সিঙাড়া ঠান্ডা হয়ে যেত, বরফিতে গড়িয়ে আসত অবহেলিত রসগোল্লার রস।
দুপুরে হয়তো অন্যরকম কিছু বিশেষ পদ থাকত। তবে আমি গালমন্দই খেতাম পেটভরে, কারণ ডান হাত থালা থেকে মুখ পর্যন্ত যেতে পথ ভুল করলেও বাঁ হাত সদ্যকেনা বইয়ের পাতা উল্টে যেতে ভুলত না।
বিকেলটা কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর লাগত আমার। চৈত্র-বৈশাখের সন্ধিতে সে এক আশ্চর্য গোলাপি গোধুলি। কেমন একটা মায়াবী বাতাস বইত, ধারেকাছে ঝাঁপালো গাছ না থাকলেও বেলফুল আর গন্ধরাজের আভাস পেতাম। আর দশদিগন্তে অন্ধকার নামত যখন… তাতেও যেন আশ্চর্য সুন্দর এক অরোরা বোরিয়ালিসের মতো আলোর আভাস থেকে যেত।
এখন, পরবাসে থেকে আমার নতুন বছর শুরু হয় দু-চারটে দূরভাষ সংযোগ খোঁজায় আর মুঠোফোনে কিছু অভ্যস্ত নিয়মরক্ষামূলক শুভেচ্ছা বিনিময়ে। অবশ্য এর জন্য কষ্ট করে বাংলা হরফ লিখতে হয় না, ছবি ডাউনলোড করে আঙুল ছোঁয়ানো শুধু। সকলেই ঘরদোর পরিষ্কার করে, ঝাড়াঝুড়ি করে; সে পাটও নেই আমার। একে তো জন্মের অগোছালো, আর তার ওপর সবেতেই অনন্ত মায়া, কিছুই ফেলতে পারি না।
এখন রোজের রান্নায় আটকে পড়ে থাকে আমার নতুন বছরের প্রথম সকাল। দুপুরের রং নিত্যনৈমিত্তিক ঘোলা গঙ্গাজল, বিকেল সন্ধে রাত আলতো গড়িয়ে যায় নিজেদের খেয়ালখুশিতে। বাংলা দেওয়ালপঞ্জি একটা মেলে কলকাতা থেকে, বৈশাখের গন্ধ থাকে না তাতে। পাকানো থাকে এককোণে, পাকানো অবস্থাতেই বছর ফুরোলে বিদায় করে দিই। নতুন বইয়ের পাতায় ভুল করে লেগে যায় না সিঙাড়ার তেলছোপ, রসগোল্লার রস। ফুলেল বাতাস বয় অন্য কোনো অচেনা অলিগলিতে।
এখন, আমার বাড়িতে বাংলা নববর্ষ ‘জাস্ট অ্যানাদার ডে’। ১ বৈশাখ আমার একলা বৈশাখ। সে নিজেই কেমন একা হয়ে গেছে!
তবুও….
আমার ‘এক’লা বৈশাখ আজ সকালে ভারি সঙ্কুচিত পায়ে দরজায় এসে কড়া নাড়ল যখন, উদাসীন মুখে দরজা খুলে দেখি বেচারি জড়োসড়ো হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু বলবে?’
সে বলল, ‘তেমন কিছু না। এই একটু দেখতে এলাম।’ উসখুসে গলায় বলে উঠলাম, ‘এমন অসময়ে আসো কেন? আমার এখন মেলা কাজ! খোশগল্প করার, তোমার সঙ্গে বসে বসে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার ফুরসত নেই।’
সে বলল, ‘জানি তো! এই যেমন আজকের দিনে ছ-বছর পেরোলো, বাবার ফোন পাও না, অথচ সেটা মনে পড়েনি। আজ এতটা বেলা হল মাকে প্রণাম করারও কথাটা বেমালুম ভুলে গেছ… ব্যস্ততার কারণেই তো! আচ্ছা, তোমার কি কিছুই মনে পড়ে না? মানে মনের কুলুঙ্গি থেকে এটাসেটা নামিয়ে ধুলো ঝাড়তেও কি ন’মাসে ছ’মাসে সাধ হয় না? এমন যান্ত্রিক জীবন ভালো লাগে?’
একটু অন্যমনস্ক গলায় বললাম, ‘একলা বৈশাখ, তুমি যখন আমার কাছে এমন একলাটি হয়ে আসতে না, সেইসব বছরগুলোর বিকেল আর সন্ধে কিন্তু ভারি সুন্দর ছিল!’
একলা বৈশাখ খুব মৃদু আর অভিমানী গলায় বলল, ‘তখনও আমি একলা হয়েই আসতাম। তোমার মনটাই আসলে অন্যরকম ছিল। তফাত ওইখানেই। ভাবনাকুটোর রকমফের।’
খুব অস্বস্তি নিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিতে দিতে বললাম, ‘তুমি এবার যাও তো বাপু! আমার এখনকার এই সারাদিনের নিয়মগুলো আর বেয়াক্কেলের মতো উল্টোপাল্টা কথা বলে চৌপাট করে দিও না!’