গ্যালিলিওকে তাঁর ছাত্র বলেছেন, দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে বীর নেই। প্রত্যুত্তরে গ্যালিলিও বলেছিলেন, দুর্ভাগা সেই দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়। সেই কথারই যেন প্রতিধ্বনি ওঠে আজকের ভারতবর্ষে। দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শিল্পীর সত্তা নয়, দুজন মানুষের বন্ধুতা নয়, তাঁদের ধর্মপরিচয়কে প্রাধান্য দিতে হয় সম্প্রীতির প্রয়োজনে। তবু এই করুণ বাস্তবের ছবিটুকুই আমাদের দেশ।
ভারতবর্ষ নামক এই সংসারটায় সম্প্রীতি যেন আজ বাড়ন্ত। হিংসা আর হানাহানির বিষবাষ্প যেন চোখে জ্বালা ধরাচ্ছে অহরহ। এই যখন হাঁড়ির হাল, তখন সম্প্রীতির সামান্য খড়কুটোর আভাসকেও আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তা ভুল নয়। কিন্তু এই আকুতিটুকু যেন মনে করিয়ে দেয় এ বড় সুখের সময় নয়। এ দেশ আজ বড়ই দুর্ভাগা।
আরও শুনুন: ধর্মপরিচয় প্রধান নয়, তিনি বাঙালি… স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন বাঙালির আইকন সত্যজিৎ
সেই দুর্ভাগা দেশেই একটি ছবি যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে আসমুদ্র হিমাচলকে। কে সেই ছবি তুলেছিলেন, জানা যায় না। শুধু জানা যায়, সেই ছবির ভিতর এমন এক মুহূর্ত বন্দি হয়ে আছে, যা আসলে এই পৃথিবীর হলেও আদতে অপার্থিব। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দাউ দাউ জ্বলছে চিতার আগুন। পঞ্চভূতে লীন হয়ে যাচ্ছে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার নশ্বর দেহ। আর একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন উস্তাদ জাকির হোসেন। চারিদিকে খাঁ-খাঁ শূন্যতা। সে-শূন্যতা বন্ধুবিচ্ছেদের। থেমে যাওয়া যুগলবন্দির। সে-শূন্যতা যেন ‘সওয়াল’হীন ‘জবাবে’র। অর্থ, নয়, কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয়; এমনকী সংসার, পরিজনও নয়; দুই কিংবদন্তি শিল্পীর যুগলবন্দি আসলে এমন এক পারস্পরিক অবলম্বন, এমনভাবে একের পরিচয়ে অন্যের মিশে যাওয়া, হয়ে-ওঠা একে অন্যের পরিপূরক, যার তুলনা খোঁজা বৃথা। রাগসংগীতের আশ্চর্য আসর সাক্ষী থেকেছে সেইসব অলৌকিক মুহূর্তের। কী অনায়াস বোঝাপড়ায় তাঁরা সংগীতের সরণি ধরে এগোতেন, একটু বোধহয় খেলাই করতেন, মাঝেমধ্যে বেশ জমে উঠত লড়াই, আর তারপর ভেসে যাওয়া এক অনাবিল আনন্দের স্রোতে। এমন এক ধ্রুপদিয়ানার জন্ম দিতে পারতেন তাঁরা, যা বন্ধন থেকে মুক্তির দ্যোতক হয়ে উঠত। এ পৃথিবীতে এরকম মুহূর্তের ঐশ্বর্য সকলে নামিয়ে আনতে পারেন না। পারতেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা আর উস্তাদ জাকির হোসেন। একজনের চলে যাওয়ায় আর-একজন তাই স্তব্ধ। উস্তাদজির ওই একলা দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে যে অনুচ্চার হাহাকার আছে, শব্দে তার অনুবাদ হয় না।
আরও শুনুন: পাশে পাননি কাউকে, স্বদেশবাসীর উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ একাই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
এই ছবি আপন করে নিয়েছেন বহু মানুষ। তবে শুধুমাত্র দুই শিল্পীর অবলম্বন আর শূন্যতাতেই এ ছবির ভাবার্থ সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তা এগিয়ে গিয়েছে ধর্মের পথে। খুঁজে নিয়েছে ওই সম্প্রীতির খড়কুটো। অর্থাৎ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার চিতার সামনে দাঁড়িয়ে উস্তাদ জাকির হোসেন, বা পণ্ডিতজির শেষযাত্রায় কাঁধ দিয়েছেন উস্তাদজি- এই মর্মে, এই ছবির ভিতরই বিভেদহীন এক ভারতবর্ষের ছবি দেখছেন অনেকে। সেই কথাটুকু তাই জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁরা।
আরও শুনুন: দিনবদলের ভাবনা ধরা দিয়েছিল ছন্দে, কবিতাও লিখেছিলেন তরুণ মার্কস
সত্যিই তো এ যদি আমার দেশ না হয়, তবে কার দেশ হবে! এই দেশেই তো উস্তাদ বিসমিল্লা খান সাহেব ফুটিয়ে তোলেন রাগ ‘দুর্গা’। এই দেশেই তো পণ্ডিত রবিশংকর আর উস্তাদ আল্লারাখা খান মেতে ওঠেন আশ্চর্য খেলায়। এই তো সেই দেশ, যেখানে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব গেয়ে ওঠেন সেই ঐশ্বরিক ‘হরি ওম তৎ সৎ’। হ্যাঁ, এই ধ্রুপদিয়ানা ভারতবর্ষেরই সম্পদ। কিন্তু কবে আর এই দেশ শিল্পীর সত্তা এবং কুশলতাকে পিছনে ফেলে তাঁদের ধর্মপরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছে! অথচ আজ সেই পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠল। দুজন শিল্পী কিংবা দুজন মানুষের বন্ধুতা নয়, দুই ভিন্ন ধর্মের বন্ধুতাই যেন আজকের ভারতবর্ষের চিহ্ন হয়ে জেগে উঠল। হয়তো এটাই নতুন বাস্তবতায় স্বাভাবিক। যে ভারতবর্ষ বুলডোজারের আস্ফালনে ক্লান্ত, যে ভারতবর্ষ হিজাব আর না-হিজাবে বিভক্ত, যে ভারতে চলে আজান বনাম হনুমান চালিশার এক্কা দোক্কা – সেখান হয়তো এই সম্বলটুকুই আঁকড়ে ধরাই স্বাভাবিক প্রবণতা। আর সেটুকুই যেন মনে করিয়ে দেশের আত্মগ্লানি, দৈন্যকেও। কতখানি বিপন্নতা আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর বাস করলে, দুজন শিল্পীর এই যুগলবন্দিকে, শেষ মুহূর্তের এই দৃশ্যটুকুকেও সম্প্রীতির নমুনা হিসাবে তুলে ধরতে হয়, তা ভেবে শিউরেই উঠতে হয়।
গ্যালিলিওকে তাঁর ছাত্র বলেছেন, দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে বীর নেই। প্রত্যুত্তরে গ্যালিলিও বলেছিলেন, দুর্ভাগা সেই দেশ, যেখানে শুধু বীরেরই প্রয়োজন হয়। সেই কথারই যেন প্রতিধ্বনি ওঠে আজকের ভারতবর্ষে। দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শিল্পীর সত্তা নয়, দুজন মানুষের বন্ধুতা নয়, তাঁদের ধর্মপরিচয়কে প্রাধান্য দিতে হয় সম্প্রীতির প্রয়োজনে। তবু এই করুণ বাস্তবের ছবিটুকুই আমাদের দেশ। তা অস্বীকারের জায়গাও বোধহয় নেই।