সে এক অতুলনীয় ও বিরল দৃশ্য! স্টেজের মাঝখানে সরোদ হাতে বসে আলি আকবর– রবিশঙ্কর এবং বিলায়েত দু’ধারে। অতি সপ্রতিভ চেহারার দুই সুপুরুষ–ভবিষ্যতে যাঁরা নিজ নিজ গুণে শাসন করবেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাস। তাঁদের দু’পাশে তবলা নিয়ে কণ্ঠে এবং কিষাণ মহারাজ, সেই কিষাণ মহারাজ যিনি হাঁটু মুড়ে নমাজে বসার ভঙ্গিতে তবলায় ঝড় তুলতেন। পিছনে পর্বতাকার দু’টি বিরাট মিরাজ তানপুরা। সামনে হাই কোয়ালিটির শিকাগো রেডিও মাইক। দর্শকাসনে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ-সহ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দুনিয়ার তাবৎ ব্যক্তিত্ব। দিল্লির অসংখ্য সংগীতপ্রিয় মানুষের দল অধীর অপেক্ষায়। সংগীত সুধারসে নিমগ্ন হওয়ার এর থেকে ভাল পরিবেশ আর কী হতে পারে!
সৌজন্যপূর্বক অনুমতি চান রবিশঙ্কর। তারপর ধীর হাতে মীড়খণ্ডে দেন মোচড়। রাগ মাঝ খামাজ। সন্ধেবেলার বড় মিষ্টি রাগ। শুরু হয় আলাপ পর্ব। সেই আলাপে মন্ত্রমুগ্ধ তামাম দর্শক। চোখ বুজে যেন ধ্যানে বসেছেন রবি! শান্ত অথচ অভিজ্ঞ আঙুল খুঁজে নিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে রস। ‘হায় হায়’ করে উঠলেন দর্শকেরা। সেতার ধরে চোখ বুজে মাথা দোলাচ্ছেন বিলায়েত। কিছুক্ষণ বাজিয়ে তাঁর দিকেই সুরমালিকা ছুড়ে দিলেন রবিশঙ্কর। এবার পালা বিলায়েতের।
সঙ্গে সঙ্গে যেন লেলিহান বিদ্যুৎ খেলে গেল মঞ্চে। চমকে উঠলেন আলাউদ্দিন, চমকে উঠল দর্শকমণ্ডলী। এ কোন গ্রহের বাজনা! এমন আলাপ তো আগে শোনা যায়নি! অসাধারণ মুনশিয়ানায় সুরের ঢেউ আছড়ে ফেললেন বিলায়েত। মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত দর্শকেরা। বহু সাধনার ফসল এভাবেও পরিবেশন করা যায়! সেদিন শেখাচ্ছিলেন এই দুই শিল্পী। বাদ যাননি আলি আকবরও। তাঁর সরোদ যে স্বয়ং ঈশ্বরের চারণভূমি, খামাজের স্বর লাগিয়ে তা তিলে তিলে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আলাউদ্দিন-পুত্র।
প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলল আলাপ, বিস্তার। মাঝে হালকা বিলম্বিত গৎ, আওচার, জোড় সেরে ঝালায় উঠে এলেন তিন শিল্পী। স্টেজজুড়ে যেন শুরু হল ঝড়! সেতারে যখন গমক সহকারে হলকা ও সপাট তান উঠে আসে, তখন তা কেমন অনুভূত হয় সেই দিন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন দিল্লির দর্শকেরা। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল– এ এখন আর সংগীতের নরম, পেলব বিচরণ ভূমি নয়, পুরোদস্তুর যুদ্ধক্ষেত্র! দু’ধারে দুই যোদ্ধা সুরের মিসাইল ছুড়ে দিচ্ছেন একে অপরের উদ্দেশ্যে। যেন বহুদিনের দুই অতৃপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী, খুঁজে পেয়েছেন রক্তের স্বাদ। দর্শকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।