‘আমি জানি, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কেমন করে আপনি বিদেশে গিয়েছেন এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে জ্ঞানার্জন করছেন। আমাদের দেশে আধুনিক যুগে আপনি এক মহান নারী। জানতে পারলাম, আপনার এখন অর্থের প্রয়োজন। আমি এক পত্রিকার সম্পাদক। আয় বেশি নয়। তবু আপনাকে ১০০ টাকা পাঠাতে চাই।’
চিঠিটি লিখছেন ‘কেশরী’ পত্রিকার সম্পাদক বাল গঙ্গাধর তিলক, আর যাঁকে উদ্দেশ করে লেখা হয়েছে, তাঁর নাম আনন্দীবাই যোশী। এক অসামান্যা ‘প্রথমা’ তিনি। কিন্তু কী তাঁর পরিচয়? কীসেই বা প্রথম তিনি?
বিয়ের আগে নাম ছিল যমুনা। ১৮৬৫ সালে মহারাষ্ট্রের থানে জেলার কল্যাণে তাঁর জন্ম। মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ে হয় ডাক বিভাগের কর্মী, বছর উনত্রিশের গোপাল রাওয়ের সঙ্গে। তিনিই যমুনার নাম দিয়েছিলেন ‘আনন্দী’।
বিয়ের পর পাঁচ বছরের মাথায় আনন্দী মা হন। এরপরের কাহিনিটি ট্র্যাজিক ঠিকই। কিন্তু কাহিনির মধ্য থেকে উঠে আসে এক সাধারণ ভারতীয় নারীর অভূতপূর্ব সংগ্রামের ইতিহাস; ‘ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ডাক্তার’–এর ইতিহাস। মা থেকে ডাক্তার হয়ে ওঠার তাঁর এই কাহিনিটিই আজ শোনাব আপনাদের।
১৮৮৬। আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে তোলা হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক ছবি, ছবিতে রয়েছেন তিন মহিলা— জাপানের কেই অকামি, সিরিয়ার তাবাত এম. ইসলামবুলি এবং ভারতের আনন্দীবাই যোশী। তিনজনই নিজেদের দেশ থেকে পশ্চিমে ডাক্তারি পড়তে আসা প্রথম মহিলা। কিন্তু মহারাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার এই যাত্রাপথ উনিশ শতকের পরাধীন ভারতবর্ষের এক মহিলার পক্ষে মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। পদে পদে ছিল সমাজ ও পরিবারের বাধা, সংস্কার আর রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল। যদিও আনন্দীবাই তাঁর লড়াইয়ের পথে পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছিলেন বলেই জানা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পরিবারের অভ্যন্তরেও তাঁকে লড়তে হয়েছিল প্রতি পদে।
মীরা কোসাম্বির লেখা বই ‘আ ফ্র্যাগমেন্টেড ফেমিনিজম: দ্য লাইফ অ্যান্ড লেটার্স অব আনন্দীবাই যোশী’ বইটি সম্পূর্ণ নতুন আলোকে তুলে ধরে তাঁর জীবনকে। জানা যায়, বাবা গণপতরাও যোশী এবং মা গঙ্গাবাইয়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন আনন্দীবাই। শৈশব কেটেছে মায়ের কড়া শাসনে। মীরা তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে এর ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন: ‘তখনকার দিনে এই ধরনের পরিবারে এমন শাসন ছিল জলভাত। কারণ এই পরিবারগুলি শৈশবেই শিশুকন্যার মন থেকে যাবতীয় মুক্তচিন্তা, স্বাধীন বিচারের শেষ দাগটুকুও মিলিয়ে দিতে ছিল তৎপর।’
কেমন ছিল সেই শাসন–পীড়ন? আমেরিকার এক বন্ধুকে চিঠিতে আনন্দী নিজে এপ্রসঙ্গে লিখছেন: ‘মা কখনও আদর করে কথা বলেনি আমার সঙ্গে। যখন শাস্তি দিত তখন ছোটখাটো কিছু দিয়ে নয়, গরম কয়লা, ঢিল অথবা লাঠি পড়ত পিঠে। ভাগ্যবশত আমার শরীরের যা গড়ন তাতে দাগ ধরত না। তাই এই প্রহারের কোনও চিহ্ন চিরস্থায়ী ভাবে থেকে যায়নি।’
তুলনায় পিতা ছিলেন কিছুটা স্নেহশীল। ছোটবেলায় আনন্দী সামান্য যেটুকু লেখাপড়া শিখতে পেরেছিলেন, বাবাই ছিলেন সেটুকুর উদ্যোক্তা।
তারপর? শুনুন…
লেখা: সানু ঘোষ
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক, শ্যামশ্রী সাহা
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস