“‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র শুটিং চলছিল। আমি আর মান্নাদা ‘আমি যে জলসাঘরে’র রেকর্ডিং করছি। একই গান, মান্নাদা গেয়েছেন, আমিও গেয়েছি। একটা ফ্লোরে আমার রেকর্ডিং হচ্ছিল, আরেকটা ফ্লোরে সুচিত্রাদের শুটিং। রেকর্ডিং শেষ হয়ে গেছে। স্কোরিংয়ের সময় ওকে ডাকলাম গানটা শুনতে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, কার গানটা বেশি ভাল লাগছে? বলল, ‘তোমারটা।’”
এতটাই মিষ্টি সম্পর্ক ছিল সুচিত্রা সেন–সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জুটির। জানালেন গায়িকা নিজেই।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সুচিত্রা–সন্ধ্যা এক কথায় ‘সমার্থক। অথচ, সুচিত্রার কণ্ঠে পয়লা প্লেব্যাক কিন্তু সন্ধ্যাদেবীর গাওয়া নয়। এমনকী, যতক্ষণ না তিনি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে তাপসী ব্যানার্জী চরিত্রটির কণ্ঠ হয়ে উঠলেন, ততক্ষণ বাঙালি শ্রোতা কল্পনাতেও এরকম মিরাকল মিল–এর কথা ভাবতে পারেননি বোধহয়। ব্যাকড্রপে পাহাড়িয়া সেট। পাশে মহানায়ক। সেই ঝিমঝিম আবেশে বাঙালি শ্রোতা মহানায়িকার ঠোঁটে শুনল ‘মিড় দোলানো সুর’। সেই ‘সুর শুধু যে ঝরাতে চায়, আবেশ ছড়াতে চায়’। মন্ত্রমুগ্ধ হল বাঙালি। ‘ভালবাসা’ ছবিতে ‘তুমি যে আমার’–এর মধ্য দিয়ে এই হিপনোটাইজিং জুটিকে আবারও ফেরত পেলাম আমরা। যদিও ছবিটির শুটিং আগেই হয়ে যায়, তবে তা রিলিজ করেছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’র পরের বছর। এদিকে তখনও কিন্তু মুখোমুখি আলাপ হয়নি দু’জনের। প্রথম পরিচয় ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী পরিচালিত ‘সবার উপরে’ ছবির গান রেকর্ডিংয়ের সময়। এমপি স্টুডিওয় গান রেকর্ডিংয়ে ব্যস্ত গায়িকা। পরিচালক এসে পরিচয় করিয়ে দেন সুচিত্রার সঙ্গে। তার আগে ‘অগ্নিপরীক্ষা’–সহ আরও অনেক সুপার হিট ছবি হয়ে গিয়েছে।
একটা সময় সুচিত্রা–সন্ধ্যা জুটি অন্য নায়িকা–গায়িকা জুটির মাইলস্টোন হিসাবে সেট হয়ে যায়, এ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁদেরকে পরস্পরের থেকে আলাদা করার কাজটি একপ্রকার কঠিন হয়ে পড়েছিল বাঙালি শ্রোতার কাছে। ঐতিহাসিক ডুয়েট ‘সপ্তপদী’র ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’–এর কথাই ধরুন। সুচিত্রার কণ্ঠে যখন গানের প্রিলিউড ডায়ালগ উচ্চারিত হচ্ছে, যা আদতে সন্ধ্যার গলা, তা নিয়ে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর সরগরম থাকত বাঙালি চায়ের ঠেক, আড্ডার আসর, দুপুরের রক এবং সান্ধ্য তর্ক। সন্ধ্যার না সুচিত্রার, সুচিত্রার না সন্ধ্যার––– এ লড়াই মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল ডার্বির চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না!
সুচিত্রার প্রয়াণের খবর মেনে নিতে পারেননি সন্ধ্যা। খবরটা পাওয়ার পর ঝপ করে প্রেশারও বেড়ে যায়। বিশ্বাস করতে পারেননি, এই নশ্বর পৃথিবীতে সুচিত্রা আর নেই। থাকবেন না। বলেছিলেন সন্ধ্যা, “অনেকে বলতেন, ‘সন্ধ্যা, তুমি কণ্ঠ, সুচিত্রা হল শরীর। আজ শরীরটা চলে গেল, দুর্ভাগা কণ্ঠটাই যা পড়ে থাকল।”
প্রয়াণ-দিনে মহানায়িকাকে স্মরণ করলেন কিংবদন্তি। প্রথম আলাপ থেকে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো, ফিল্ম ছাড়ার সিদ্ধান্ত থেকে আধ্যাত্মিক জগতে পা, ভরত মহারাজের কাছে যাওয়া থেকে শেষ দেখা––– কেমন ছিল সুচিত্রা–সন্ধ্যা জুটির ঐকান্তিক দিনগুলি?
গায়িকা ভাগ করে নিলেন টিম ‘শোনো’র সঙ্গে। শুনলেন, শ্যামশ্রী সাহা।
লেখা: শ্যামশ্রী সাহা, সোহিনী সেন
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক
আবহ: শুভাশিস চক্রবর্তী