ছেলেটা খালি বাড়ি থেকে পালায়। বাবা–মা থেকে আত্মীয়, সকলেই বিব্রত এমন ঘর পালানো ছেলের কীর্তিকলাপে। ১১ বছর বয়সে একেবারেই বাড়ি থেকে ‘ভাগল্বা’ হয়ে গেল ছেলেটি। বাবা ছিলেন এলাকার নামজাদা মাস্টার। ১৬ জন সন্তানের মধ্যে এ–ই বড়। খুব তুচ্ছ কারণে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ছেলে বাড়ি ছেলেছিল। মা আবার সৎমা। বাড়িতে ঘি নেই নাকি! রুটিতে ঘি এত কম কেন! এই ছিল কারণ! অনেক পরে, তখন তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের বিখ্যাত পণ্ডিত হয়েছেন, হয়েছেন ‘পণ্ডিত ভীমসেন যোশী’। এক সাক্ষাৎকারে গুলজার সাহাবের কাছে ঠাট্টা ভরে বলেছিলেন: ঘি-টি বলা একেবারে অজুহাত। কিছু একটা কারণ দেখাতে তো হতই। ওটাই কারণ ধরে নিন। আসলে গুরুর খোঁজে বেরিয়েছিলাম। আমাদের অঞ্চল গদগে গান শেখানোর মতো সেরকম উস্তাদ বা গুরু ছিলেন অমিল।
ঘর পালানোর অভ্যাস আগেও ছিল। তখন যোশী পরিবার থাকে পুণেতে। বাজনা–বাদ্যি হলেই ছোট্ট ভীমসেন সেই ব্যান্ডের পিছু নেন। যদ্দুর শরীর দিল তদ্দুর। তারপর আর ফেরার ঝক্কি না পুহিয়ে, মন্দিরের চাতালে, ফুটপাথে, বন্ধ দোকানের সামনে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। আবার খোঁজ–খোঁজ রব ওঠে। কখনও এমনিতে হয় না। পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয়। এতবার, এত-এত বার এমন ঘটনা ঘটে যে বিরক্ত হয়ে ভীমসেনের বাবা তাঁর নানা জামায় লিখে দেন এক মারাঠি জুবান, ‘যোশী মাস্টারারা মাগা’। যার অর্থ: ‘এই ছোঁড়াটি যোশী মাস্টারের পুত্তর’…
বয়স তখন ১১। উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ সাহাবের প্রথম এলপি রেকর্ড রিলিজ হয়েছে। সেখানে ছিল বসন্ত রাগে আধারিত ‘পিয়া বিন নাহি আওত চ্যান’। সেই সময়েই কিশোরের মনে সংকল্প তৈরি হল: গায়ক হবেন, হবেনই। আর গান গাইলে, এরকমই গাইতে হবে, অন্যথায় নয়। তার জন্য যা করণীয় তিনি করবেন।
তখন সংগীত মানচিত্রে গোয়ালিয়র একটি অত্যন্ত বিখ্যাত জায়গা। কিশোর ভীমসেন ঠিক করলেন, গুরুর খোঁজে, সেখানেই যাবেন। শুরু হল অন্বেষণ, শুরু হল পথচলা। অতঃপর বাড়ি থেকে পালিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেন। কাছে টাকাকড়ি কিস্যু নেই। মারাঠিরা গানবাজনার ব্যাপারে অনেকেই বেশ শৌখিন, সেই এক ভরসা। শোনা রেকর্ডের মধ্যে কিছু কিছু ছেলেটি অসম্ভব সুন্দর নকল করে গাইতে পারতেন––– পণ্ডিতরাও নাগারকর, নারায়ণরাও ভ্যাসজি, অবশ্যই উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ-এর গান তো বটেই। এইসব শুনিয়ে টিকিট কালেক্টরদের খুশি করতেন। যাঁরা গানবাজনায় উৎসাহী, তাঁদের যদ্দুর ডিউটি, তদ্দুর ছেলেটির যাত্রা নির্ভাবনা। আর যাঁরা গানবাজনা বিষয়ে আনাড়ি, তাঁরা ধরে হাজতে পুরে দিতেন। আবার সেখান থেকে বেরিয়ে সেই গোয়ালিয়র অভিমুখে যাত্রা।
তারপর শুনুন…
লেখা: সুশোভন প্রামাণিক
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস