৭ জানুয়ারি জন্মদিন ইরফান খান-এর। মৃত্যুর পর এই প্রথম জন্মদিন। ‘অভিনয়’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই ভেসে আসে মানুষটার সাবলীল মুখ। নিপাট–নিটোল হাসি। আর স্বতঃস্ফূর্ততার ঝিলিক। ক্লান্তিময় কোনও এক দিনে পেলব হাওয়ার মতোই আরাম এনে দেয় তাঁর অভিনয়। চারপাশে হাজারো আলো জ্বলে ওঠে যেন। তবে অভিনয় যত না, তার চেয়ে ঢের বেশি উদ্যাপন করতেন জীবন, বেঁচে থাকা আর প্রকৃতি। মারণরোগের যন্ত্রণাকেও কোন এক জাদুমন্ত্রে যেন উদ্যাপন করতে শুরু করেছিলেন। সবই ‘ম্যাজিক্যাল’ মনে হত। ইরফানের এই চরিত্রের জন্যই হয়তো বা, তাঁকে, তাঁর সংস্পর্শ আর সান্নিধ্যকে ম্যাজিক্যাল মনে হত সহকর্মীদেরও। তাঁর বং কানেকশন নেহাতই হালকা নয়। সুজিত সরকার-এর সঙ্গে কলকাতা রাস্তায় চুটিয়ে অভিনয় সেরেছেন ‘পিকু’র। একই ছবির সূত্রে আলাপ সুরকার–গায়ক অনুপম রায়-এর সঙ্গেও। ‘ডুব’ ছবির জন্য অভিনেত্রী পার্নো মিত্র শুটিংয়ের সূত্রে তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছেন ৪০ দিন। প্রাণোচ্ছলতায় ভরপুর মানুষটার স্মৃতি টিম ‘শোনো’র সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তিনজন। শুনলেন শ্যামশ্রী সাহা।
সুজিত সরকারের মতে ইরফান ভারতের ‘মোস্ট নোন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্টর’। ইন্টারন্যাশনালি সবথেকে ভাল ভাল মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করেছেন প্রোডাকশন হাউস, অ্যাক্টর, ডিরেক্টর। সুজিতের সাফ বক্তব্য,‘মনে হয় না ভারতে আর কেউ আছে ওর মতো যে এত ট্যালেন্টেড লোকজনের সঙ্গে কাজ করেছে। আমি খুব প্রিভিলেজ্ড যে ও আমার সঙ্গে কাজ করায় সম্মত হয়েছে আর আমি ওর সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি।’ তবে কাজ নিয়ে যত না, তার চেয়ে ঢের বেশি কথা হত অধ্যাত্মবাদ নিয়ে। ব্রাহ্মসমাজের কথা হত। রামকৃষ্ণকে নিয়ে কথা হয়েছে। যখনই দেখা হত, এই কথোপকথন চলত সুজিত–ইরফানের। কাজ করতে করতে একপ্রকার বন্ধু হয়ে যান দু’জন। ইরফানের অনেক সিক্রেট ভাগ করে নেওয়ার সৌভাগ্য হয় সুজিতের। সৌভাগ্য হয় অনেক ক্লোজ ডিসকাশনের সঙ্গী আর শরিক হওয়ারও। অভিনয় যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করতেন জীবন। সুজিতের জবানিতে, ‘শরীরখারাপটা অনেক বড় ধাক্কা ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল নিজেকে ম্যাজিক্যাল আর ক্রিয়েটিভ জায়গায় নিয়ে পৌঁছে দেওয়ার। নিজের ট্রিটমেন্টটা খুব বেশিরকম এক্সপিরিয়েন্স করত। প্রতি মুহূর্তে ওর সঙ্গে কথা হত। বলত, আজ এটা শিখলাম, কাল ওটা জানলাম। ট্রিটমেন্ট হলে এটা হয়, ওটা হয়। তুমুল ব্যথা–যন্ত্রণা সত্ত্বেও খালি বলত, শরীরের মধ্যে ম্যাজিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স হল। অ্যাক্টিং বা ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে ওর যে–ভিশন ছিল, সেখানে কোথাও না কোথাও একটা ম্যাজিক দেখতে পেত। আর যখনই ও ম্যাজিকের কথা বলত প্রচণ্ড খুশি হত। কীরকম একটা উৎফুল্ল দেখাত ওকে। সেটা বোঝা যেত।’
‘পিকু’–র সুরকার অনুপম রায়ের সঙ্গে ইরফানের দেখা হয় মাত্র দু’বার। দুটোর কোনওটার সঙ্গেই যদিও গান বানানো বা রেকর্ডিংয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। জানাচ্ছেন অনুপম, “আমি মুম্বই যাই ‘পিকু’র কাজে। সুজিতদার অফিসেই ছিলাম। গল্প করছিলাম। ছবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেসময় ইরফান ও তাঁর স্ত্রী ঢোকেন। সুজিতদা আলাপ করিয়ে দেন সংগীত পরিচালক হিসাবে। তারপর সামান্যই কথা হয়। প্রথম আলাপ। অল্পক্ষণের জন্য। পরেরটা দীর্ঘ। ছবির প্রিমিয়ারের সময়। তিনটে প্রিমিয়ার হয়। আমি মুম্বইতে ছিলাম। প্রথম হিন্দি ছবি। এক্সাইটেড ছিলাম। বাংলা ছবির থেকে আলাদা প্রিমিয়ার। ‘পিকু’র সব আর্টিস্টরা ছিলেন। সবাই খুব আনন্দ পেয়েছিল। বিশেষত ইরফান। ইরফানের সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়। উনি যে ধরনের ছবি করে থাকেন সাধারণত, তাতে তো গানের অত প্রাধান্য থাকে না। সে জায়গায় ‘পিকু’ ছিল এমন একটা ছবি যেখানে ইরফান রোমান্স করছেন, গান বাজছে। এটায় চরম মজা পেয়েছিলেন।”
‘ডুব’ ছবির শুটিংয়ে ইরফানের অভিনয় হাঁ করে গিলতেন পার্নো। বাংলাদেশে ৪০ দিনের মতো কাটিয়েছিলেন তাঁরা। ঢাকার অনতিদূরে গাছপালা–লেকঅলা একটা জায়গা। সেখানে শুটিং ছাড়া বাদবাকি সময়টুকু একহয় প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে, নয়তো ক্রিকেট খেলে কাটাতেন ইরফান। তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত পার্নো জানাচ্ছেন, “ভীষণ চিল্ড আউট একটা ক্যারেক্টার। কোনও ব্যাগেজ নেই। লাঞ্চ ব্রেকে একসঙ্গে খেতাম। লাঞ্চব্রেকের পর দু’ঘণ্টা ক্রিকেট প্লেয়িং টাইম হত। ক্রিকেট খেলতে ও খুব ভালবাসত। মেন্ডিটারিলি খেলতও। আমাদের জোর করে ফিল্ডার বানত।” অভিনেত্রীর সংযোজন, ‘মাছ–মাংস খেত না। হি ইজ আ ভেজিটেরিয়ান। অরগ্যানিক ফুড নিয়ে কথা বলত। নিজের মতো থাকত। ইকো–ফ্রেন্ডলি জিনিস পছন্দ করত। কথাও বলত এসব নিয়েই।’
শুনুন…
লেখা: শ্যামশ্রী সাহা
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক, শ্যামশ্রী সাহা
আবহ: শুভাশিস চক্রবর্তী