শান্তিনিকেতনে একসময় প্রতিমা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘মা-মণি, আমার কাছে যাঁরা আসেন তাঁদের সময় ব্যর্থ যাবে না, আমার ক্ষমতা আছে প্রতিদানের। তাঁদের অধ্যাত্মলোকে আমার শেষ স্পর্শ রেখে যেতে পারব।’’
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।
… …
দিয়েছি উজাড় করি’
যাহা কিছু আছিল দিবার
প্রতিদানে যদি কিছু পাই
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই।। (শেষ লেখা, ১০)
দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ক্ষীণ হয়ে যায় এইসময়, কানে বিশেষ শুনতে পেতেন না। শান্তিদেব ঘোষ গান শোনাতে এলেও সকল সুর শুনতে পেতেন না, আক্ষেপের সুরে বলতেন, ‘আমার কানে সুরের সব নোট স্পর্শ করে না’। অসুস্থ শরীরেও দোল উৎসবের আয়োজনে কোনো সমস্যা যাতে না হয় সেই বিষয়ে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নটীর পূজা-র রিহার্সাল আরম্ভ করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। ১৩৪৮ (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ সম্ভবত) বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ, এই নববর্ষ কবির মনে এক ভবিষ্যতের নিবিড়তার স্পর্শ এনেছিল যেন, লিখেছিলেন-
দূরত্বের অনুভব অন্তরে নিবিড় হয়ে এলো।
… …
আজি এই জন্মদিনে
দূরের পথিক সেই তাহারি শুনিনু পদক্ষেপ
নির্জন সমুদ্রতীর হতে। (জন্মদিনে, ১)
এই দিনেই তিনি সভ্যতার সংকট-এর অভিভাষণ দিয়েছিলেন। সেই জন্মদিনের উৎসবে আমের সাজিতে ভরে যায় রবীন্দ্রনাথের ঘর! রবীন্দ্রনাথ কি বুঝতে পেরেছিলেন, এই তাঁর শেষ জন্মদিন? তাঁর লেখা যদিও সেই উপলব্ধির গভীরতায় নিয়ে যায় আমাদের,
জন্মদিন, মৃত্যুদিন দোঁহে যবে করে মুখোমুখি
দেখি যেন সে-মিলনে
পূর্বাচলে অস্তাচলে
অবসন্ন দৃষ্টি বিনিময়
সমুজ্জ্বল গৌরবের প্রণত সুন্দর অবসান।। (জন্মদিনে, ২৬)
১৩৪৮-এর ২২শে শ্রাবণ , ১২টা ১০ মিনিট। স্তব্ধতা আসে, চিরকালীন স্তব্ধতা। মৃত্যু কার্যত পরাস্ত করে তাঁকেও। পৃথিবীর ইতিহাসে, বাংলার ইতিহাসের সেই ২২শে শ্রাবণ, স্মরণীয় এক দিন।
সেইদিন, সেইক্ষণ, প্রতিমা দেবীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই ঠাকুরদালানে দীক্ষিত হবার মন্ত্র, যে মন্ত্রে স্নেহের ‘মা-মণি’-কে দীক্ষিত করেছিলেন তাঁর ‘বাবামশায়’, ‘অসতো মা সদগময় তমসো মা জ্যোতির্গময়’। শেষ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সজ্জা হয়েছিল তাঁর লেখা অনুযায়ীই–
অলংকার খুলে নেবে একে-একে, বর্ণসজ্জাহীন উত্তরীয়ে
ঢেকে দিবে, ললাটে আঁকিবে শুভ্র তিলকের রেখা;… (জন্মদিনে, ২৯)
২২শে শ্রাবণ। জোড়াসাঁকোর এক উৎসবের দিনও বটে! অবনীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিন, অথচ সেই বাইশ সমস্তটুকুকে ম্লান করে দেয়! ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ কাকাকে অন্তিম শয্যায় দেখতে থাকেন। অবন ঠাকুরের তুলি তাই মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথকে তখনই অমর করে দেয় হয়তো! শায়িত রবীন্দ্রনাথ, তাঁর উপর এক উজ্জ্বল আলোকদীপ্তি আর নীচে অন্ধকার।
লেখা: বিতান দে
পাঠ: সুশোভন প্রামাণিক
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস