বৃদ্ধ, যুবক, নারী, শিশু, সব মিলিয়ে অন্তত কুড়ি হাজার মানুষ। সকলেই নিরস্ত্র। আর তাদের উপরেই চলছে নির্বিচারে গুলি। রক্তে ভিজে উঠছে জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি। হ্যাঁ, সেই কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথাই বলছি। এই ঘটনার প্রতিবাদে নাইট ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সে কথা জানা। কিন্তু জানেন কি, ঠিক কেমন ছিল সেদিন তাঁর সামগ্রিক প্রতিবাদের ছবিটি?
ইংরেজ শাসনের প্রতিবাদে তখন একটু একটু করে রুখে দাঁড়াচ্ছে গোটা দেশ। স্বাধীনতার দাবি উঠতে শুরু করেছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অব্দি। একদিকে গান্ধীজির আদর্শে অহিংসার পথ, আরেকদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে চলেছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। তার পালটা জবাবে নেমে আসছে ব্রিটিশের দমন পীড়নও। আর তারই সবচেয়ে পৈশাচিক রূপটি বোধহয় দেখা গিয়েছিল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সেই সময়ে যাঁরা ভারতীয় রাজনীতির পরিচিত মুখ, তাঁদের কাউকেই সেভাবে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। অথচ যিনি কবি বলেই নিজের পরিচয় দিয়ে এসেছেন আজীবন, প্রত্যক্ষ রাজনীতির শরিক হয়ে উঠতে চাননি সেভাবে, এই সময়ে ক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠলেন সেই রবীন্দ্রনাথই। তাঁকে আশ্রয় করেই যেন ভাষা পেল গোটা দেশের প্রতিবাদ। সুদূর পাঞ্জাবে ঘটা এই নৃশংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ল বাংলায়, ছড়িয়ে গেল ভারতে, এমনকি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। একা হাতে সেদিন এই প্রতিবাদকে চালনা করেছিলেন সেই ঋষিপ্রতিম মানুষটিই।
আরও শুনুন: উপাসনায় গরহাজির শিক্ষক-পড়ুয়ারা, কী করেছিলেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ?
সেসময় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে খবর ছড়িয়ে পড়া সহজ ছিল না। বিশেষ করে পাঞ্জাবে তখন জারি করা হয়েছে সামরিক আইন। নিজেদের এই অমানুষিক কীর্তিটিকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি ব্রিটিশ সরকার। তবুও ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে আভাসে ইঙ্গিতে সেই খবর এসে পৌঁছেছিল কবির কানে। সেই ভাসা ভাসা খবরটুকু পেয়েই তিনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “পাঞ্জাবের দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে।” এমনকি সেই সময়েই শান্তিনিকেতনে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিত থাকার কথা ছিল, কিন্তু সেই সবকিছু ছেড়ে তিনি ছুটে আসেন কলকাতায়। এদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পরে গান্ধীজি যেন দেশবাসীর প্রতিই খানিক হতাশা প্রকাশ করলেন, প্রত্যাহার করে নিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনও। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পাঞ্জাবে যাওয়ার অনুরোধ করলেও তিনি রাজি হননি। এরপরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে নিজে গিয়ে প্রতিবাদসভা ডাকার আরজি জানিয়েছিলেন কবি। তিনি নিজে যে সেই সভায় সভাপতি হতেও রাজি আছেন, জানিয়েছিলেন এ কথাও। কিন্তু তাতেও বিশেষ সাড়া মেলেনি।
আরও শুনুন: ব্রিটিশদের তুষ্ট করতেই ‘জনগণমন’ লিখেছিলেন Rabindranath Tagore! সত্যিটা কী?
এরপর কী করলেন রবীন্দ্রনাথ? তিনি নিজেই যে লিখেছিলেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”। এবার সেই পন্থাই বেছে নিলেন তিনি। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জানিয়েছেন, কবি বলেছিলেন, “অথচ আমার বুকে এটা বিঁধে রয়েছে কিছু করতে পারব না, এ অসহ্য। আর আমি একাই যদি কিছু করি, তবে লোক জড়ো করার দরকার কি? আমার নিজের কথা আমার নিজের মতো করে বলাই ভালো।”
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
কীভাবে সে কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? বড়লাটকে দীর্ঘ চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, নাইটহুড সম্মান ত্যাগ করছেন তিনি। সেই চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, তাঁর দেশবাসীর প্রতি যখন মানুষের অযোগ্য অসম্মান ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই সময়ে নিজের সমস্ত বিশেষ সম্মান-চিহ্ন বর্জন করে তাদের পাশেই তিনি নেমে দাঁড়াতে চান। নিজের অপমান অসম্মানের তোয়াক্কা না করে সেদিন মানবতার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত এই চিঠির জেরেই বিদেশের সংবাদপত্রগুলিতে এরপরে জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ড নিয়ে কথা চালাচালি শুরু হয়েছিল। তদন্তের দাবি উঠেছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে। আর এ সবকিছুর উৎস ছিল মাত্র একজন মানুষের সেই একটিমাত্র চিঠি।