একজন মানুষ। যন্ত্র নেই, যন্ত্রী নেই। আলোর পরোয়া নেই। আছে ওই দার্শনিক ঈক্ষণ। আছে রাজনীতি। আর সুরের বহুমাত্রিক চলন। এইসব সামান্য উপকরণের অসামান্য ইন্দ্রজাল সময়েরই ইন্ধনে। গান নেমে আসে মঞ্চ থেকে। গান, ততক্ষণে কমরেড। ডিঙ্গা ভাসানোর সাথি। গান পেয়েছে শরীর। দর্শক দেখেছে, অনাগত আবহমানের দিকে দু’হাত মেলে গাইছেন, গাইছেন মানুষটা- প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
প্রয়াত কিংবদন্তির স্মরণলেখনে সরোজ দরবার। ছবি সায়ন্তন ঘোষ।
করুণ ভায়োলিন বাজছে। এই শহর জুড়ে। ইতিহাস ধরে হেঁটে আসা সংগীতের ঘর-গেরস্থালিতে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন, বাংলা গানের চ্যাপলিন?
ঘাম। আসলে শ্রমের চিহ্ন। শ্রমের ভিতর ইতিহাস। মানুষের। বেঁচে থাকার। লড়াই, সংগ্রামের। মানুষের মৃত্যু হলেও যে মানব থেকে যাবে, সেই উদ্ভাসী বিশ্বাসের দিকে এগিয়ে যাওয়া যে প্রসারিত ইতিহাস-চেতনা, তার প্রকাশ বুঝি ওই স্বেদবিন্দুতে। গাইতে গাইতে ঘেমে-নেয়ে না-উঠলে আর হল-টা কী! গান। সে তো কুর্নিশ জানাবে চ্যাপলিনকে। বলবে, লাল টুকটুক স্বপ্ন না-বেচার কথা। আলু, ছোলা যা ইচ্ছে বেচা যায়। কিন্তু কোনও মূল্যেই স্বপ্ন বিক্রি নেই। গান তো চাইবেই ভাঙা ডালে আবার সূর্য বসাতে। এবং মাও সে তুঙ। যাঁরা তাঁকে পড়বেন না, চাইবেন না, তাঁর দিকে ফিরেও তাকাবেন না, তাঁদের মন থেকে মননে যেন আশ্চর্য অন্তর্ঘাত হয়ে ঢুকে পড়বে গান- সব মরণ নয় সমান। বন্দিমুক্তির মুহূর্তে উড়বে গানের নিশান। গাইবেন একজন লোক। ‘লোকটা নিজেই আস্ত একটা গান’। খালি গলা। একমাথা ঝড়। গান তো কমরেড। ডিঙ্গা ভাসানোর আগে, সামাল সামাল। সমবেত, কোরাস। অথচ গান গাওয়া মানুষটি একক। তাঁর প্রতিটি পারফরমেন্সই একক অনুষ্ঠান। একজন মানুষ। যন্ত্র নেই, যন্ত্রী নেই। আলোর পরোয়া নেই। আছে ওই দার্শনিক ঈক্ষণ। আছে রাজনীতি। আর সুরের বহুমাত্রিক চলন। এইসব সামান্য উপকরণের অসামান্য ইন্দ্রজাল সময়েরই ইন্ধনে। গান নেমে আসে মঞ্চ থেকে। জনতার মুখরিত সখ্যে। যেমন নেমে এসেছিল বাদল সরকারের থিয়েটার। মানুষের গানের উৎসার মানুষের ভিতর থেকেই। একজন ধারণ করবেন যেন সেই গানকে। তারপর গান আর মানুষটি বদলে ফেলবেন একে অন্যের আত্মা। মানুষ দেখবে, যে গান নিয়ে তাঁরা ফিরছেন, আসলে ফিরছেন মানুষটিকে নিয়েই। তাঁর বক্তব্য, দর্শন, রাজনীতি নিয়েই। কেননা গান, ততক্ষণে কমরেড। ডিঙ্গা ভাসানোর সাথি। গান পেয়েছে শরীর। দর্শক দেখেছে, অনাগত আবহমানের দিকে দু’হাত মেলে গাইছেন, গাইছেন মানুষটা- প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
ঐতিহাসিকতাই এই বাংলার বুকে তৈরি করেছিল প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে। তিনি যে জনগণ্যতা অর্জন করলেন তা ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রমী চিহ্ন মাত্র নয়। বরং সময়ের ইতিহাসই তৈরি করেছে এই স্বতন্ত্র অভিজ্ঞান। সংগীত মানুষকে একত্র করেছে, সমষ্টিগত চেতনায় বেঁধে রেখেছে। সে বহুকালের কথা। উপাসনা বা ধর্মাচরণের প্রসঙ্গটি তুলে রাখলেও দেখা যাবে, সামাজিক পরিবর্তনেও সংগীত সঙ্ঘবদ্ধ করে মানুষকে। কীর্তন, যা কিনা বিশেষ করে কিছু বলাও। কথা। গানের মধ্যে সেই কথা ছড়িয়ে দেওয়ার গুণ। কথাসূত্রে অনেকের মিলে যাওয়ার ক্ষমতা। কীর্তন তাই প্রবহমান। স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে সলিল চৌধুরী, কীর্তনের থেমে থাকা নেই। মুকুন্দদাস, লালন হোন বা কাজী নজরুল ইসলাম- হে আমার আগুন, পুনঃ পুনঃ উঠেছে জ্বলে। ধনঞ্জয় বৈরাগী, বিশুপাগলরা এসে কেবলই গান শুনিয়ে যায়, আসলে গানে গানে বলে যায় কথা। ঋত্বিক ঘটক এপিটাফে আশ্রয় নেন রবীন্দ্রনাথের গানে। এই চেতনার পথেই আইপিটিএ পর্ব আসে বাংলায়। শিল্প আর রাজনৈতিক চেতনা যে পৃথক নয়, এই বোধ বাংলার ঐতিহাসিকতার সূত্রেই পাওয়া। এবং সে-পথ ধরে হাঁটলে তবেই পাওয়া যায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর অন্য এবং অনন্য গানকে। এককের গান, তবে নির্জনের নয়, জনগণের। সত্তর যে ভাঙাগড়ার সাক্ষী রইল তা রাজনৈতিক ভাবে ব্যতিক্রমী। প্রতুলও। ব্যারিটোন নয়। রোগা একজন মানুষ। তবুও তিনি মঞ্চ দখলকারী। তাঁর স্বর স্বতন্ত্র। তবে মিনমিনে কিংবা রিনরিনে নয়। জোরালো, বলিষ্ঠ। প্রত্যয়ী। ঠিক তাঁর বক্তব্যের মতোই। রাজনীতির মতোই। সে-রাজনীতি দলীয় নয়। কোন্দলীয় তো নয়ই। সে-রাজনীতি অতীত থেকে সম্প্রসারিত আবহমানে। বিশ্বায়ন উত্তর পুঁজিনিয়ন্ত্রিত এই ছদ্মবেশী শিশ্নোদরতন্ত্রী প্রতারক সময়েও যে প্রতুল মুখোপাধ্যায় থেকে গেলেন, তা আস্ত এক রাজনৈতিক বয়ান যেন। দিকে দিকে ধ্বংসের চিহ্ন। আক্ষেপ। নীতি আর দুর্নীতির দ্বন্দ্বে রোজ প্রথমের পরাজয়। এমত সময়েও, যেন আত্মপ্রত্যয় হয়েই থেকে গেলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। নির্লজ্জ সময় তাঁকে আত্মগোপনের অবকাশটুকু দেননি। ব্যক্তি আর শিল্পে ছুরি চালিয়ে দেওয়া সময়ের তল্লাশি অভিযান। ফলত অভিমান জমেছে এদিক-ওদিক। তা তাঁর অজানা ছিল না। তবু গানই তাঁর পাতালের চিরকুট, তাঁর রাজনীতি। সে-রাজনীতির চিহ্ন থাকে ঘামের নুনে। বাংলার ত্রস্ত নীলিমায়। তা ফিকে হয় না। গাইতে গাইতে ঘেমে ওঠা একজন মানুষ। মঞ্চ কিংবা দল তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
তবু কিছু প্রহসন। সময়ের নিছক নরক। সেই সব জঞ্জাল চিৎকার করে সারা দিন, সারা রাত। অথচ শিশুর সারল্যে হেসে ওঠেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ‘ভবিষ্যৎ হল বর্তমানের গর্ভে পোঁতা এমন এক পূর্বনিয়ন্ত্রিত বোমা যার বিস্ফোরণের মুহূর্ত গোনা শুরু হয়ে গেছে’- স্পেন্ডারের এই কথা ধরেই হানা আরন্ট জানতেন, যাঁরা সেই প্রহর গোনার আওয়াজ শুনতে পান, তাঁরাই এ-প্রজন্ম। এ-কথা জানতেন নবারুণ যে, এইসব বিস্ফোরণের খবর জানতে রাষ্ট্রশক্তির ঢের বাকি আছে! এবং জানতেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ও। জানতেন, নরকের এক ঋতু পেরিয়ে আবার কেউ গেয়ে উঠবে, ভোরের আকাশ রাঙা হল সাথি, ঘুমায়োনা আর জাগোরে…। যে গাইবে সে ভবিষ্যৎ। গাইবে জাগরণের গান, ডিঙ্গা আবার ভাসবে…। সেদিন, সেই ভবিষ্যতেরও সাথি হবেন লোকটা, প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
সুতরাং অতুলনীয়-র উপমান এই বাংলা তার আপনগুণে আরও পাবে। তবু, প্রতুলনীয় উপমা বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব; ব্যতিক্রমী এবং একক অর্জন।