কার্টুন কে না ভালোবাসে! রং-তুলিতে চাপা হাসি আর মাপা কথার এমন প্রকাশ যেমন কঠিন, তেমনই তা বাঙ্ময়। চিরকালের নির্ভীক সত্তা কার্টুন অনায়াসে প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুড়ে দিতে পারে প্রশ্ন, এখনও। কার্টুনের সেই শক্তি আর স্বাধীনতার উদযাপনই এবার পাচ্ছে ভিন্নমাত্রা। এই প্রথমবার কলকাতা শহরে বসছে কার্টুন মেলা, সৌজন্যে ‘কার্টুন দল’।
সামান্য দু-এক তুলির আঁচড়। আর তার সঙ্গে লাগসই মন্তব্য বা বিবৃতি। স্বল্প কথায় আকাশসমান ব্যঞ্জনা প্রকাশের ক্ষমতা যদি কারও থেকে তবে তা যতটা কবিতার, ততটা কার্টুনেরও। যেমন তার ধার, তেমনই ভার। কার্টুন এমন এক শিল্প, যা না-দেখাকে দেখতে শেখায়। ভাবনার রসদ জোগায় মগজে। এমনকী রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমালোচনা কিংবা প্রশ্ন করতেও কার্টুন অকুতোভয়। শিল্পের স্বাধীনতা আর সামাজিক দায়বদ্ধতার এমন মেলবন্ধন কার্টুনকে শুধু জনপ্রিয়-ই করেনি, দিয়েছে অন্য এবং অনন্য মাত্রা।
আরও শুনুন: ফেলুদার প্রতি ‘দুর্বলতা’ নেই, জানিয়ে কিশোরী ভক্তের ‘তিরস্কার’ জুটেছিল সৌমিত্রর
সেই কার্টুনকেই এবার নিজস্ব মেজাজে সেলিব্রেট করতে চলেছে শহর কলকাতা; যেভাবে সে উদযাপন করে সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারাকে। এই প্রথম শহরে কার্টুন নিয়ে হবে উৎসব, বসবে মেলা। আয়োজনে, ‘কার্টুন দল’। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ‘ছোটামোটা ফাউন্ডেশন’। ৫ ডিসেম্বর থেকে মেলার সূচনা দক্ষিণ কলকাতার রিডবেঙ্গলি বুক স্টোরে। চলবে এক মাস অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে দলের অন্যতম সদস্য শিল্পী উদয় দেব জানালেন, “আগামী বছর বাংলা কার্টুনের ১৫০ বছর। ভারতের কার্টুনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। দেখা গেছে, বাংলা আর দক্ষিণ ভারতেই সবথেকে বেশি কার্টুনিস্ট জন্ম নিয়েছেন। আবার এ বছরই রেবতীভূষণ ঘোষের ১০০ তম জন্মদিন। বাংলা কার্টুনের ১৫০ বছরের ইতিহাস থাকলেও, সেভাবে কার্টুন নিয়ে বড় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই কার্টুন দল এই মেলা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আর এই মেলা আমরা উৎসর্গ করছি রেবতীভূষণ ঘোষকে, তাঁর ১০০ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হিসেবে।”
আরও শুনুন: সাহেব-বিবি-গোলাম টানা ঔপনিবেশিকতা নেই, একেবারে স্বতন্ত্র বাংলার দশাবতার তাস
অবশ্য রাতারাতি যে এই ভাবনা বাস্তবায়িত হয়েছে এমনটা নয়। কার্টুন দলের ধারাবাহিক কাজের ফলশ্রুতি হিসেবেই রূপ পেতে চলেছে এই মেলা। ২০১৪ সালে কার্টুন দলের যাত্রা শুরু, রাজ্য চারুকলা পর্ষদের মেলার মাঠ থেকে। এর আগে বাংলার কার্টুনিস্টরা এরকম সংঘবদ্ধ হয়ে সেভাবে কাজ করেননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডঃ শুভেন্দু দাশগুপ্ত, যিনি নিজেও কার্টুন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন, তিনিই এই দল বাঁধার একেবারে গোড়ার কাণ্ডারি। যত দিন গিয়েছে দলে সদস্য যেমন বেড়েছে, তেমনই বহুবিস্তারে ছড়িয়েছে নানাবিধ কর্মকাণ্ড। কার্টুন নিয়ে গবেষণা, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সামগ্রিক বাংলা কার্টুনের ইতিহাসকে ফিরে দেখা ও ধরে রাখার কাজ করে চলেছে কার্টুনদল। এবার তাই এই মেলার মাধ্যমে সেই কাজকেই অন্য মাত্রা দিতে চাইছেন দলের সদস্যরা।
আরও শুনুন: ফ্যাশন নয় আন্দোলনের অংশ, সেকালে সমাদর পেয়েছিল ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি
শুধু কার্টুনের প্রদর্শন নয়, কার্টুন যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা এই মেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন বাংলার কার্টুনশিল্পীদের অমূল্য সৃষ্টি। থাকছে ‘এক ব্যাগ কার্টুন’ সংগ্রহের সুযোগ। আর থাকছে ওয়ার্কশপ। দেবাশিস দেব, অবিন চৌধুরীর মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সামনে বসে হাতে-কলমে তালিম নেওয়ারও সুযোগ থাকবে। শিল্পী উদয় দেব বলছেন, “উৎসব মানেই তো এক ধরনের মিলন। এখানেও একরকম সুযোগ থাকছে যাতে তরুণ শিল্পীরা সিনিয়র শিল্পদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। এই পেশা সম্পর্কে তাঁদের যাবতীয় প্রশ্ন, সন্দেহ বা কৌতূহল নিরসনের জায়গা করে দেবে এই মেলা।”
আরও শুনুন: মামলায় অভিযুক্ত খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেষমেশ কী হল পরিণাম?
এই বাংলায় কার্টুন নিয়ে যে আস্ত এক উৎসব হচ্ছে, নিঃসন্দেহে তা গুরুত্বপূর্ণ। বছর কয়েক আগে কার্টুন নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। যদিও তা ঠিক কার্টুন ছিল না, ছিল কোলাজ। কার্টুন নিয়ে চর্চা যত বাড়বে তত এই ভ্রান্তি দূর হবে, এমনটাই অভিমত শিল্পী উদয় দেবের। তিনি তাই বলছেন, ” বাংলায় কিন্তু কখনওই কার্টুনে মানা করা হয়নি। বাম আমলে বা বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বর্তমান সরকার যদি কার্টুনের বিরোধিতা করত, তাহলে কিন্তু প্রবীণ কার্টুন শিল্পীদের যত্ন করত না বা কার্টুন দলকে নিয়মিত মেলায় স্টল দিত না। কার্টুন দল বরং সেই জায়গা থেকেই এই মেলার কথা ভাবতে পেরেছে যে, এই রাজ্যে অন্তত কার্টুনকে উদযাপনের স্বাধীনতা ও পরিসর রয়েছে।”
আরও শুনুন: শুধুই খেলনা নয়, ছাপোষা মানুষের প্রতিবাদের প্রতীক হল তালপাতার সেপাই
বাংলায় কার্টুন মেলা তাই বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গে যেমন নতুন অলংকার, তেমনই শিল্পী ও শিল্পের স্বাধীনতারও উদযাপন। হাঁসফাস গণতন্ত্রের বন্ধ গড়ে, এই বাংলার দিকে তাকালে যে এখনও আকাশ দেখা যায়, সে কথাই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে কার্টুন নিয়ে এই উদযাপনের উদ্যোগ।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।