শতাব্দীপ্রাচীন এই পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বের তাবড় লেখকরা। তাঁদের মধ্যে আছেন উইলিয়াম ফকনার, স্টিফেন কিং, সল বেলোর মতো কিংবদন্তিরা। সেই তালিকায় সংযোজিত হল বাঙালি সাহিত্যিক অমর মিত্রের নাম।
বিশ্বের দরবারে অনন্য স্বীকৃতি বাংলা ছোটগল্পের। বিশ্বখ্যাত ছোটগল্পকার ও হেনরি-র নামাঙ্কিত পুরস্কার পেলেন সাহিত্যিক অমর মিত্র। বাঙালি কথাসাহিত্যিকের এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তি সামগ্রিক ভাবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গৌরবজ্জ্বল মুহূর্ত।
আরও শুনুন: ফেলুদার প্রতি ‘দুর্বলতা’ নেই, জানিয়ে কিশোরী ভক্তের ‘তিরস্কার’ জুটেছিল সৌমিত্রর
বাংলা ছোটগল্পের ঐশ্বর্য বিপুল। কথাসাহিত্যের সেরা শিল্পীরা এই ভাষাতেই তাঁদের শিল্প রচনা করেছেন বললে অত্যুক্তি করা হয় না। তবে আঞ্চলিকতার ঘেরাটোপে হয়তো ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে সেই বিস্ময়-সম্ভার। সেভাবে তার উপর পড়েনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আলো। বাঙালি পাঠক আর ভিন্ন ভাষার কতিপয় সাহিত্য অনুরাগীর আদর ছাড়া বাংলা ছোটগল্পের তেমন কদর মেলেনি বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, মোটের উপর এটাই ছিল বাস্তবতা। এতদিনে যেন সেই আক্ষেপ পূরণ হল বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীর। ও হেনরির নামাঙ্কিত শতাব্দীপ্রাচীন পুরস্কার এল বাংলা সাহিত্যের ঝুলিতে। আনলেন অমর মিত্র, তাঁর ‘গাঁওবুড়ো’ গল্পের দৌলতে।
আরও শুনুন: সৌমিত্র কি সত্যিই অমন ফরসা? গায়ে চিমটি কেটে দেখেছিলেন অজানা ভক্ত
সেই ১৯৭৭ সালে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘অমৃত’ পত্রিকায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এক বুড়োর যাত্রাপথের গল্প এটি। কুসুমপুর থেকে কন্যাডিহি চলেছেন তিনি জনৈক বড়বাবুর সন্ধানে। যে বড়বাবু তাঁর যাবতীয় দুঃখ যন্ত্রণা মিটিয়ে দেবেন, এমনটাই বিশ্বাস গাঁওবুড়োর। পথ অতিক্রম করতে আরও কত মানুষের কত কিসিমের দুঃখের সঙ্গে, যাপনের যন্ত্রণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হতে থাকে। গাঁওবুড়ো এগিয়ে চলেন প্রার্থিত উপশমের সন্ধানে। সেই বড়বাবুর সঙ্গে আদৌ কি তাঁর দেখা হবে? এই প্রশ্নের উত্তরেই গল্প পৌঁছায় তার চূড়ান্ত পরিণতিতে। আসলে অকীর্তিত মানুষের জীবনের চাওয়া-পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার যে যাত্রাপথ, আর তার যে অন্তিম বিন্দু, সেখানেই পাঠককে নিয়ে যান লেখক। সেই বিন্দুতে জেগে থাকা আবেদন পাঠককে শুধু মুগ্ধই করে না, জীবন এবং জীবনের মর্মের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাংলা ছোটগল্পের ভাণ্ডারে ইতিমধ্যেই এই গল্পটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অনীশ গুপ্তের ইংরেজি অনুবাদে সেই গল্পই হয়ে ওঠে ‘দ্য ওল্ড ম্যান অফ কুসুমপুর’। যা পেল ও হেনরি নামঙ্কিত পুরস্কার। শতাব্দীপ্রাচীন এই পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বের তাবড় লেখকরা। তাঁদের মধ্যে আছেন উইলিয়াম ফকনার, স্টিফেন কিং, সল বেলোর মতো কিংবদন্তিরা। সেই তালিকায় সংযোজিত হল বাঙালি সাহিত্যিক অমর মিত্রের নাম।
পুরস্কারপ্রাপ্তির মুহূর্তে স্মৃতির সরণি ধরে লেখক ফিরে গিয়েছেন সেই গল্প প্রকাশের দিনে। শারদীয়া সংখ্যায় ছাপা হয়নি এ-গল্প, প্রকাশিত হয়েছিল পরবর্তী সাধারণ সংখ্যায়। সম্পাদক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন তরুণ লেখককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আগের সংখ্যায় গল্প না ছাপতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মার্জনা চেয়ে নিয়ে লেখককে উপহার দিয়েছিলেন ‘কুবেরের বিষয় আশয়’। সেই মুহূর্তটিকে মনে করে সাহিত্যিক অমর মিত্র বললেন, “উদাত্ত হৃদয়ের মানুষ ছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই কতবছর আগে, আমার ২৬ বছর বয়সে লেখা এই গল্প। আর কিছুদিন পরে গল্পটার বয়সই ৫০ হয়ে যাবে। এতদিন পরে যখন সেই লেখা স্বীকৃতি পায়, তখন গল্পের নিজস্ব জোরটাই প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি তাই সকলকে বলব, লিখে যাওয়াই আসল কাজ। অনেকেই কথায় কথায় বিদেশি লেখা ও লেখকের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। পাশাপাশি আমাদের দেশে, আমাদের ভাষাতেও যে অনেক ভাল লেখা হচ্ছে, সেই কথাটাও সকলে বলুন। এই পুরস্কার অন্তত সেই বলে উঠতে পারার ক্ষেত্রে একরকমের আত্মবিশ্বাস জোগাবে। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য ছোটগল্প লেখা হয়েছে, হচ্ছেও। বিদেশের স্বীকৃতি না এলে তা স্বীকার করব না, বা তাকে নিন্দা করব – এই ধরনের ভাবনাচিন্তা থেকে আমরা যেন বেরিয়ে আসতে পারি। আমি আর একটা কথাই শুধু বলতে চাই, একজন লেখকের ভাল লিখে যাওয়াটাই কাজ। ভাল লিখলে স্বীকৃতি মিলবেই। সবসময় পুরস্কারই যে স্বীকৃতি তা নয়, পাঠকের স্বীকৃতিও লেখকজীবনের বড় প্রাপ্তি।”
এই পুরস্কারে বাঙালি পাঠক যে আজ খুশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামগ্রিক ভাবে বাংলা সাহিত্যের জন্যই এই মুহূর্ত আনন্দ এবং গর্বের।